Featured Post

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যা...

Saturday, November 20, 2021

জীবনের নিরন্তর বিচরণের চালচিত্র বিতান চক্রবর্তীর ‘ল্যান্ডমার্ক

 

জীবনের নিরন্তর বিচরণের চালচিত্র বিতান চক্রবর্তীর ‘ল্যান্ডমার্ক

শাশ্বত কর

 

 




বিতানের গল্পের সাথে পরিচয় অনেকদিনের। ব্যক্তি বিতানের সাথে পরিচয় অবশ্য তারও আগের। সেই স্কুল থেকে। একই স্কুল। একই মাস্টারমশাই। একই নাটকের দল। অনেকটা একই ভাবে মনোভূমি তৈরি করে দিয়েছিলেন গহর স্যার, নির্মলস্যার। সেই সময়ের অসংখ্য স্মৃতিকে এক করে এই ব্যক্তিগত কথাটুকু বলার দরকার এই কারণে যে ব্যক্তি বিতান আর গল্প লিখি    য়ে বিতানের কোনো ফারাক আমি চোখে দেখি না। চারপাশ দেখে যেমন বোঝে, যেমনি অনুভব করে তেমনি বলে। চরিত্র ছাড়া আর কিছু বানানোর দিকে হাঁটে না। সহজ কথা স্পষ্ট করে বলার অদ্ভুত দক্ষতা আছে ওর। আগেও দেখেছি, ‘সাম্প্রতিকতম’ গল্পের বইটাতেও তার ব্যতিক্রম দেখলাম না।

কেবল দেখলাম গল্প বলার মুন্সিয়ানা আরও বেড়ে গেছে। অদ্ভুত মোচড় দিচ্ছে গল্পের নানা জায়গায়। ছোটো ছোটো বাক্যে নির্মেদ স্মার্ট কথন। গল্প বলার সময় নিজের আবেগটাকে বেশ কষে বেঁধে রেখে গল্পটাকেই বলছে। ফলে গল্পই আবেগ উসকে দিচ্ছে পাঠকের। ব্র্যাভো!

সব থেকে ভালো লাগার বিষয়, এ হলো একেবারে পরিচিত পরিবেশের গল্প। সিদ্ধার্থ, মলিদি, সমীরদা, নলিনাক্ষ,অহন, শান্তিবুড়ি, মনসা- আরও সব চরিত্ররা- যারা গল্পগুলোর আনাচে কানাচে, রাস্তায়, বাড়িতে বিচরণ করে গল্প ফুটিয়ে তোলেন, তারা কেউই আমাদের অপরিচিত নন। এদের দেখি আমরা রোজ। কেউ হাঁটেন, কেউ লোকাল ট্রেনে চাপেন, কেউ ট্রেনে ফেরি করেন, আবার কেউ উদ্বায়ী দ্রব্যের মতো অদ্ভুত যাদুতে মুহূর্তে সাতভাঙা সাইকেল থেকে বাইক হয়ে ফ্লাইটের নিত্য সওয়ারি হয়ে যান। কেউ উদ্বাস্তু হয়ে যান ভিটেমাটি থেকে, কেউ পরিজন স্বজন থেকে কেউ বা আদর্শ থেকে।  এদের গল্পও আমরা শুনি। কিন্তু এত সব ‘কাজকম্মের’ মধ্যে কোথায় যেন তারা হারিয়ে যান। ‘ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট ব্যথা, কে রাখে খবর তার!’ বিতানকে ধন্যবাদ! ও কেবল খবর রাখে যে তা নয়, খবরের দলিল তৈরি করে। নীরস দলিল না, মালাকারের মুন্সিয়ানায় ঘাসফুলও মনোরম লকেট হয়ে ওঠে।

একটা নরম অথচ তীব্র ভাষার দখল আছে বিতানের। গল্পের মধ্যে কাব্যময়তা খুঁজে পেয়ে গল্পকে তার জায়গা থেকে সরানোর পক্ষে নই। তা হয়ও নি ওর 'ল্যান্ডমার্কে'। তবু ভাষাই তো অক্ষর থেকে অনুভবটাকে মনে নিয়ে আসে, সেই ভাষার পেলবতার কথাই বলছি। অত্যন্ত তীব্র, চোখা ঘটনাকে আলতো করে ঢেলে দিচ্ছে সাদা পাতায়! ভাবটা এমন যে, পাঠক হে! তুমি এবার ঠেলা সামলাও! ‘ভাবো! ভাবা প্র্যাকটিস করো!’

ছোটগল্পের যেমন গুণ থাকা দরকার, তার যথেষ্টই আছে গল্পগুলোয়। বাহুল্য নেই, যতটা দরকার ততটাই বর্ণন, তাতে পাঠকের চিত্তপটে গপ্পের দৃশ্যপট গড়ে উঠতে কোনো সমস্যা হয় না। দুধের ক্যান,  পরোটা, ডাস্টবিন, উচ্ছিষ্টের ভাগবাঁটোয়ারা, তেলচিটে গামছা, চশমা, মানিব্যাগ- টুকরো টুকরো ছবি গল্পগুলো সাজিয়ে তোলে। নাটকের ছেলে বলেই কি না জানিনা, দেখার চোখ আছে, মঞ্চ সাজানোর দক্ষতা আছে। গল্প যেখানে গড়ে উঠছে, স্খানে পৌঁছে যেতে পাঠকের তাই সমস্যা হয় না একেবারে।

এই প্রত্যেক কথার সপক্ষে গল্পগুলো থেকে উদাহরণ তুলে তুলে দিতে পারতাম। কিন্তু সে কাজ আমার পছন্দের নয়! ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির অধ্যাপক বলতেন ‘আগ্রহ তৈরি করাটাই আসল কাজ, বলে দেওয়া নয়! সুগন্ধির ঢাকনা এমন ভাবে খুলে দাও যাতে মন আপনিই সেই সুগন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়!’ বিতানের নতুন গল্পের বইটার প্রতিটা গল্পের পাঠ শুরু করলে তেমন একটা আগ্রহ জাগে, গল্পের শেষ অবধি টেনে নিয়ে যায়। কখনও কখনও শেষের মোচড়টার রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ। যার জন্য একবারে একটা করে গল্পই আমি পড়তে পেরেছি বইটা থেকে।

রোজকার ঘটে যাওয়া ঘটনার আধারে গড়ে ওঠা বিতানের নতুন বই এর পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে গিয়ে মৌসুমী ভৌমিকের মন কেমন করা গানের সুর ভেসে উঠল মনে। ‘শরীরটারই ভিতরে পরাণ নামের কী যেন কে থাকে, তারই ডাকে আমি ঘর বাহির করি!’ ঘর, বাইরের জীবনের নিরন্তর বিচরণের চালচিত্র গড়ে উঠেছে বিতানের ল্যান্ডমার্কে। প্রকাশককেও ধন্যবাদ মনোজ্ঞ পরিবেশনের জন্য। প্রচ্ছদ থেকে নির্ভুল পরিবেশন- গোটা প্রোডাকশনটাই খুব উচ্চমানের। পাঠকের ভালো লাগবে বলেই আশা রাখি।

 

ল্যান্ডমার্ক, বিতান চক্রবর্তী, শাম্ভবী, হার্ডবাউন্ড, মূল্যঃ ২০০ টাকা

 

Friday, July 30, 2021

এমনই বরষা ছিল সে দিন

 


সময় রহস্যময় । তার রূপ দেখা যায় না, ফলে হাতে তার কোন অস্ত্র, সে জানাও দুঃসাধ্য। নিজের খেয়ালে চলে। অস্ত্র নয়, বোধহয় রং তুলি তার হাত জুড়ে । কী অদ্ভুত ভাবে পরিবর্তন আঁকা হয়ে যায় । মাঝে মাঝে যখন বাইরের ছবি দেখে ভিতরে তাকাই, মনে হয় এই বদল ভিতর ঘরেই বেশি। বাইরের যে বদল , সে পুরো দস্তুর নিয়মানুবর্তী । নিয়ম মেনে চাকায় চেপে ঘোরে। ঘুর্ণনের নিয়মে সে বদলের ছবি প্রায়শই এক। একমুখী বদলে যায় কেবল ভিতরের ঘর। বদলে যায় ভিতর ঘরের চার দেয়ালের রং। সে দিনের রং একরকম, তারুণ্যের ভোরে একরকম, আবার তারুণ্যের মাঝ আকাশে তার রং আর একরকম।



এই যে রাত ভর বৃষ্টি- ছেলেবেলায় বৃষ্টি আগেও হতো, এখনও হয়। জল এখন যেমন জমে, আগেও জমতো। বাড়ির পাশের ফাঁকা জমির মোথা মোথা শন, ঘাস, কচুবন, মোল্টা, কালকাসুন্দি, বনতুলসি জলে ডুবে ডুবে মাথা নাড়তে নাড়তে একদিন হলদে হয়ে যেত। মরা নারকেলের গুঁড়ি চেপে ছিপছিপে সোনাব্যাঙ । আধডোবা স্থলপদ্মের গাছে গোলাপি ফুলের পাশে দুধশাদা বক। সন্ধ্যে হলেই ঝিঁ ঝিঁ আর ব্যাঙের কাওয়ালি। জমে থাকা জল তখন খেলার মাঠ । হাওয়া কমে যাওয়া সাদা বল ভাসছে জলে, কয়েক জোড়া ছোট ছোট পা ঝুপুস ঝুপুস করছে জল ঘিরে। ভিজে চুপ্পুস! পুকুর ভেসে গেছে! কই উঠে আসছে উঠোনে । ইশকুল যেতে পিছলে পড়ছে ছেলেবেলা। ইশকুলে রেইনি ডে। বৃষ্টি নেমে আসছে পুকুরে! গাছের ডাল থেকে জলে ঝাঁপ দিচ্ছে ছেলেবেলা। ডুব দিয়ে শুনে নিচ্ছে বৃষ্টি আর পুকুরের মিলনসঙ্গীত! খিচুড়ির গন্ধ ভাসছে বাড়িতে। পাতের পাশে থাবা মাপছে মিনি আর পাঁচিলে অপেক্ষায় বসে আছে ভিজে শ্বারমেয়। 

অথবা বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে ছাতা, ছাতা চুঁইয়ে জল নামছে , জল নেমে যাচ্ছে পোশাক ছুঁয়ে মনের ভিতরে । জলের ছোঁয়ায় উত্তাপ! উত্তাল সমুদ্র আছড়ে পড়ছে মনের পাড়ে। পাড় ভেঙে যাচ্ছে । বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে । 'পুড়ে যায় অধরোষ্ঠ আগুনে ও বানে!' ওতপ্রোত হয়ে আছে যুগল সময় । সার্সির বাইরে জল ঝরছে, যুগল হাত ছুঁয়ে নিচ্ছে জল! অটোর বৃষ্টিতে, রিক্সার বৃষ্টিতে, লোকাল ট্রেনের দরজা ছোঁয়া বৃষ্টিতে ভাপ উঠছে। মহাকবি মৃদু হাসছেন, ছুঁয়ে দেখছেন মেঘদূত।


গতকাল সারারাত আকাশ কেঁদেছে। অশ্রু জমে আছে রাস্তায় । অশ্রুর উদ্বেগ ছুঁয়ে আছে মনের আকাশ । বাইরের আকাশে বদল খুব বেশি হয় নি। বদলে গেছে ভিতরের আকাশ । সেখানে আনন্দের বৃষ্টি ইদানিং খুব বেশি হয়না, বরং কাজ আর নিলামের দৌড় থামানো বৃষ্টি । জল জমে আছে রাস্তায় । কত কিছু কাজ পড়ে আছে, কত কাজ, কত কাগজ, কত ধমকি, কত দৌড়, ফের ধমকি, ফের কাগজ, ফের দৌড় । এই বৃষ্টিতে সব পন্ড । বৃষ্টির নাম উদ্বেগ। বাজার ঘাট, ওষুধপত্র...প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটু। কপাল কুঁচকে বিরক্তি!

সব কিন্তু একই আছে, কালোমেঘেই এখনও বৃষ্টি হয়, বদলে গেছে কেবল ভিতরের দেয়াল। সেখানের সাদা রঙে কখন যে ভুষো কালি লেপে দিয়ে গেছে সময় মালুমই হয় নি! 

30.07.2021


কপিরাইট: শাশ্বত কর 

রাতভর বৃষ্টি 




Friday, July 23, 2021

ছাতা, আষাঢ় আর হরিপদ

 

 

ছাতা, আষাঢ় আর হরিপদ

শাশ্বত কর

 

 


 

মনে পড়ছে

বেশ কিছু দিন আগে একটা ছবি, বলা যায়, ভাইরালই হয়েছিলহার্বাল ছাতা প্রযত্নে স্বনামধন্য বাবা বিষয়টা এমন কিছু নয় একটা বড় কচু পাতা তা, গ্রামে গঞ্জে অমন হার্বাল ছাতা বর্ষাদিনে সকলেই দেখেছে!

আমিও দেখেছি আমাদের হরিপদই তো কত সময় মাথায় দিয়ে প্রাইমারি ইস্কুলে যেত এই রে! হরিপদর কথা সেই এসেই গেল! এক অদ্ভুত জ্বালা! আশ্চর্য সমাপতন! ছাতা টানলেই হরিপদ যেন কোত্থেকে পাকা পোনার মত ঘপল ঘপল ঘাই মেরে ওঠে!

এই যে হরিপদ, কিন্তু সত্যিইসাদামাটা ছোট খাটো লোক এখনও, আড়াই যুগ আগেও

যে সময়টার কথা এখন মনে আসছে, হরি তখন ক্লাস সেভেন বলা বাহুল্য, আমিও তাই মফস্বলের ইস্কুলে পড়ি হরিপদর মজ্জায় মজ্জায় তখনআষাঢ় নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’-হরিপদ তাই যায়ও না! গেলেও ছাতা মাথায় যায় আর আমাদের ওখানে তখন আকাশে মেঘ মানেই মাটিতে জল সে জৈষ্ঠ হোক, বা শ্রাবণ- বৃষ্টি হল তো জল জমবেই ছই ছাপা ছই, ছপাক ছই...কদম কদম জল ছিটিয়ে চলা ডাঙায় এলেও বুটের ভিতর থেকে জমা জল পায়ের চাপে ফোয়ারা! মজাই মজা! বাদ কেবল হরিপদ! হাতে চটিজোড়া আর মাথায় লম্বা ডান্ডি দাদুর ছাতা! এমন ছাতা যেআকাশ ভরা সূর্য তারাআগা গোড়া দৃশ্যমান আষাঢ় মানেই হরিপদর হাতে ওই ছাতা, আর ওই ছাতা মানেই আষাঢ় এল বন্ধুরা যে জন্যে ওকে কত বার ছাতাপদ বলেও ডেকেছে! কিন্তু হরি নির্বিকার আলতো পায়ে জল ঠেলে ঠেলে বিড়বিড়ে বুজকুড়ির আলপনা পিছনে ছড়িয়ে সুবোধ হরি ধীর পায়ে হেঁটে গেছে বাড়ির পথে!

বর্ষার আদত মজা কিন্তু গ্রামে গঞ্জেই শহরে না আছে দিগন্ত, না দিগন্ত ঝাপসা হওয়া তুমুল বরষণ বাড়ির সান শেড বাড়ির চাল চোঁয়ানো জল শুধু হরদম জল জমে ঠিকই, তবে তাতে যেমন আবর্জনা ভাসে, পাড়াতে মন চায় না কেবল, বেরোতে যদি না হল, তবে ঘরে বসে জানালার পাশে আষাঢ়ের বৃষ্টি আর রেডিওতে আষাঢ়ে গল্প নয়তো গজলের সুর শুনতে বেশ লাগে কিন্তু, গ্রামের আষাঢ় সত্যিই লাবণ্যময়ী! এক এক দিনে তার এক এক রূপ!
যে দিন আসে, মায়ার উচ্ছলতায় চারদিক হেসে ওঠে সবুজের শোভা না হয় বাদই দিলাম, টুকরো টুকরো জমা জলে ডাহুকের লাজুক স্নান- সে কি কম? ঝপঝপিয়ে দুটো ডুব দিয়েই লুকিয়ে পড়ে নারকেলের গুঁড়ির পিছনে ছুপি দিয়ে দেখে নেয় কেউ দেখছে না তো! নিশ্চিন্ত হয়েই ফিরে এসে ফের ডুব! অনাবিল আনন্দ! কত গপ্প, কত কবিতা, কত প্রবন্ধ, কত না ছবি! তাও অধরা থেকে যায় আষাঢ়ের সম্পূর্ণ রূপ সে রূপের ছোঁয়া চেনে কেবল ছেলেবেলা পুকুর ধারে নুইয়ে আছে বকুলের ডাল বৃষ্টি হচ্ছে, এমন সময় সে ডালে উঠলেই দেখা যায়, কেমন করে ধোঁয়ার মত জল এসে মিশছে জলের বুকে জলের কণার মতই ছেলেবেলাও তখন বাঁধন হারা- ঝপাঙ করে লাফিয়ে পড়ে...জলের মাঝে আকুল করা শীতলতা! সেই শীতলের কোনটি যে বরষার আর কোনটি পুকুরের তার বিভেদ করে সাধ্য কার? চোখে মুখে তখন কেবল আষাঢ়ের আদর, আর ডুব দিলে জলের উপর আষাঢ়িয়া নুপুরের ঝমঝম আহা! সেই মোহময় ছন্দ যে শুনেছে, সেই মজেছে যে শোনেনি, সেই হতভাগ্যকে না হয় অন্য কোন সময় স্মরণ করব

এমন বর্ষার দিনে স্কুল যেতে হলে বর্ষাতি পড়তে হত রেইন কোট যে কোন ফেংশুই বিশেষজ্ঞ, নিশ্চিত, সেগুলোকে ঘাড় নেড়ে দুর্ভাগ্যের সূচক বলবেনই উফ! কী সব রঙ! কচি কলাপাতা, নইলে পাকা সুপুরির মত গেরুয়া, নয় তো নয়ন তারার মত উজ্জ্বল বেগুনী! তায় মাথায় টুপি আর পিঠে উঁটের মত ব্যাগের কুঁজ কুকুরের আর কী এমন দোষ! দেখলেই স্বাভাবিক মেজাজ সপ্তম অমনি তড়বড়িয়ে তাড়া

তাড়া বলে তাড়া! আছাড় না খাওয়া পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি নেই আর আছাড় মানেই কাদা..সেই অজুহাতে ছুটি..অথচ জল ছড়িয়ে বাড়ি আসতে বেলা..আর বাড়িতে এলেই...থাক! সে কথা আর নাই বা বললাম, সবাই জানেন

আরও একটু বড় হলাম যখন, মানে ওই নাইন- টেন হবে, ছাতা পেলাম কিন্তু আসল কম্মটিকে বাদ দিয়ে সে ছাতার কত না কাজ! হকি খেলা, লেঙ্গি মারা, ক্লাস চলাকালীন খোঁচানো- সব তো আছেই এমন কি ছুটির পরে ফিরতি পথে সেই ছাতা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জল ছেটানো! বৃষ্টি না এলেও তাকে ডাকাআয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে ডাকবেনা? বৃষ্টি এলেই তো ছাতায় ছাতায় আষাঢ় বরণ! উপচে ওঠা খাল, বিল, বা নর্দমা থেকে মাছ ধরার নামে কাদায় জলে জল কেত্তন! আহা! কত সব সুনেহেরা পল!

তবে কেবল ছেলেরাই নয়, বড়রাও কিন্তু ছাতার অনেকই অপব্যবহার করত ইস্কুলে, বাড়িতে যে ছাতাপেটা হত, সে কি অপব্যবহার নয়! তবে হরিপদকে কোনদিন ছাতাপেটা হতে হয় নি হবেই বা কেন? তো আজন্ম মধ্যপন্থী থার্ড বা ফোর্থ বেঞ্চের তিন নম্বর সিটে সবসময় চুপ করে বসে থাকত আলাদা করে তাই কখনও চোখেও পড়ত না

কী মুশকিল দেখেছ! সেই আবার হরিপদটা ঘুরে ফিরে এসে উঠছে!

অবশ্য আসবারই কথা! ছাতা হোক, আষাঢ় হোক, হরিপদর কথা আসবেই ওর যে গোটা জীবনটাই বর্ষা বাবা নেই বাবার ভিটেটা কেবল আছে আর আছে মা দিদি বিয়ে হয়ে শহরে ওদের বাড়ির অবস্থাও ওর মতই, না ভাল, না খারাপ দালান বাড়ি, টালির চাল ভিতরের দিকে চালের জায়গায় জায়গায় কৌটো বাঁধা ঘর বাদ দিলে গাছ গাছালিতে ভরা ভারি সুন্দর ওদের জায়গাটা রাস্তার একদম উপরেই কতবার গিয়েছি!

কাকিমাকে একবার হরির এই মিয়ানো স্বভাব নিয়ে নালিশ করেছিলাম কাকিমা বলেছিলেন, ‘ কী করবে বল, মাথার উপরের আসল ছাতাটাই তো ওর নেই!’

ছাতাও কিন্তু ভারি আশ্চর্য বিষয়! ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়! আবার ছাতা বদলালে মানুষটাও কেমন বদলে বদলে যায়! কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে তো লাল, নীল, গেরুয়া, সবুজ কত ছাতাই দেখলাম! ছাতার নিচে তরল মানুষও দেখলাম কত! সে যাই হোক, ইউনিভার্সিটির বর্ষা কিন্তু বেশ অন্যরকম কালিদাসের বর্ষা বলা যায়আষাঢ়স্য প্রথম দিবসএর মাহাত্ম্যটা এখানেই ঠিকঠাক মনে সেধোয় বৃষ্টির টিপ টিপ অন্তঃকরণে দহন ধরায়পুড়ে যায় অধরোষ্ট’- শক্তি চাটুজ্জের বর্ণমালা ওড়ে বর্ষণে বর্ষণেশাওন বরষে, তরসে দিল..কিউ না ঘরসে নিকলে দিল...’! সত্যিই বৃষ্টি এলে মন ঘর ছাড়া আঙুলে আঙুল রেখে ভিজে যাওয়া পায়ে জড়িয়ে আসে মৃত ঘাস লেকের ধারে সার সার ছাতা..ছাতার ওই পারে সার সার বর্ষাধোয়া পা আমাদেরও ছাতা আছে খুলিনি আষাঢ় মাখছি সারা শরীরে বরণ করে ডাকছিঃএসো আষাঢ়! নদী ভরিয়ে দাও দুই পাড় থেকে ঝুপ ঝুপ ভেঙে যাক সঞ্চিত মাটি..’ আষাঢ়ই তো আমাদের একান্ত ছাতা তাকে আড়াল করতে আরেকটি ছাতা! নৈব নৈব সে করে তো করুক হরিপদ!

নাঃ!এবার সত্যি সত্যি জ্বালাল দেখছি!

জ্বালাতে সত্যিই পারে হরিপদ গরমের ছুটিতে সেবার গেছি স্বাভাবিক, হরির বাড়িতেও গেলাম আগের দিনই কালবোশেখি হয়ে গেছে সে তখন বাড়িতেই সেই দাড়ি গোঁফ কামানো মিনমিনে মুখ আলাদা করে ডেকে বললাম নিজের কথা বললাম, ‘কী রে! তোর কি খবর? ভিজছিস নাকি কোথাও?’ উত্তর দিল না বললাম, ‘নতুন একটা ছাতা বেরোচ্ছে জানিস? এক্কেবারে তোর জন্যেই ছাতাটা নাকি আবহাওয়ার আগাম খবর দেয় পাক্কা পাঁচদিনের! তোর মত সাবধানী মানুষের জন্যে একদম পারফেক্ট!’ জবাব নেই ধুত্তোর! বললাম, ‘অদৃশ্য একটা ছাতা বেরিয়েছে রে হরি! চিনে ছোয়াঙ ওয়াঙ না, কে একজন বানিয়েছে! শুধু একটা নল, বুঝলি? কোনো কাপড় টাপড় নেই নলের বোতাম দাবালেই নিচ থেকে হাওয়া ব্লো করবে উপরে- ব্যস! বৃষ্টির ছিটে ফোঁটাও আর গায়ে লাগবে না! এই বেশ জলও পড়বে, আড়ালও থাকবে না এখানে এলে একটা নেব, তুই নিবি নাকি?’ এতেও চুপ! এতটা বেরসিক হল কবে? উঠব বলে নড়াচড়া করতেই হাতটা ধরল বলল, ‘চল নিয়ে গিয়ে দেখাল রাস্তার ধারের বকুল গাছটার একটা ডাল বড় একটা চাক হয়েছে সেখানে বলল, ‘মৌমাছির ছাতাটা দেখ!’ রেগেমেগে বললাম, ‘তুই দেখ! হাঁদা কোথাকার!’

দিন পনের বাদে আষাঢ় এল খবরও এল শুনেই ছুটে গেলাম হাসপাতালে বেডে শুয়ে শুয়ে হরি বলল মাস ছয়েক ধরেই নাকি চলছে এই তাণ্ডব! শুরুটা হয়েছিল শীতের গোড়ার দিকে রাত সেদিন তখন প্রায় দশটা! শীতের মফস্বলে যথেষ্ট গভির হঠাৎ ফট ফট...ফট ফট...কে রে? আমি! আমি কে? আমি প্রোমোটার!

হরিপদ সাদামাটা ছোট খাটো কর্মী মৌমাছি। তাই ছাতা ওর প্রাণ। স্বাভাবিক প্রতিরোধ। ক্ষমতা মত হুল। ফল স্বরূপ মৌলি প্রোমোটারের ধোঁয়ায় বেধড়ক ধুম ধাড়াক্কা! কাকিমা যখন সেই সময়ের কথাগুলো ওখানে বসে বলছিলেন আমার রবি ঠাকুরের কথাগুলো মনে আসছিলঃ ‘...উপরে উঠে চার দিক বেয়ে কালো মাথার কোন চিহ্ন দেখতে পেলুম না- সমস্ত ফ্যাকাশে ধু ধু করছে। একবার বলু বলে পুরো জোরে চিৎকার করলুম- কন্ঠস্বর হু হু করতে করতে দশ দিকে ছুটে গেল, কিন্তু কারও সাড়া পেলুম না। তখন বুকটা হঠাৎ চার দিক থেকে দমে গেল, একখানা বড় খোলা ছাতা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে যেমনতর হয়’। হরি বলল, ‘আমার ছাতাগুলো, জানিস, ঠিক ডোরেমনের ছাতার মত! আকাশের খসে পড়া তারা ওই দিয়ে ধরা যায়, কিন্তু রাখা যায় না!’

হরিপদরা যেদিন চলে গেল, সে দিনও আষাঢ়। শনশনে হাওয়া। ছাতার মত কালো মেঘ ছেয়ে। বৃষ্টি এল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। এই প্রথম ছাতা নিল না হরিপদ। চিবুক দিয়ে গড়িয়ে এল আষাঢ়। ‘জলে নয়ন আপনি ভেসে যায়’!

বাড়ি ফিরে জানালা দিয়ে দেখলাম, ইউক্যালিপটাসের ধপধপে গা বেয়ে ঘিয়ের স্রোতের মত আষাঢ়ের জল নামছে। মানিপ্ল্যান্টের চওড়া পাতা চুঁইয়ে নামছে জল আর সেই পাতার নিচে দুটো ব্যাঙ, চারটে শালিখ। ছাতায় ছাতায় বর্ষা বরণ!

আসলে কি জানেন, গতকাল খবরে বলল, বর্ষা আসতে আর মাত্র সপ্তা খানেক, আর পরশুই ডাকে একটা চিঠি এসেছে। নেমন্তন্নের কার্ড! কার্ডে লেখাঃ ‘শ্রীমান লোকনাথের শুভ অন্নপ্রাশন’। একটা ফুটফুটে গাবলা গোবলা বাচ্চার ছবি! নিচে লেখা- ‘ তোমলা এস কিন্তু!’ তারিখঃ পয়লা আষাঢ়, স্থানঃ ছত্রধর ভবন, তেহট্ট, নদীয়া।

হরিপদর এই নয়া ছাতায় আষাঢ় বরণ দেখার জন্যে মনটা খুব টানছে। খুবই। তেহট্টের দিকে ঠিক কোন কোন ট্রেন যায়, বলতে পারেন?


প্রকাশিতঃ কলকাতা 24x7.com (https://magazine.kolkata24x7.com/22-05-2016-arshinagar-saswata-kar/), 29.05.2016

copyright: Saswata Kar