ছাতা, আষাঢ় আর হরিপদ
শাশ্বত কর
মনে পড়ছে।
বেশ কিছু দিন আগে একটা ছবি, বলা যায়, ভাইরালই হয়েছিল। ‘হার্বাল ছাতা’। প্রযত্নে স্বনামধন্য বাবা। বিষয়টা এমন কিছু নয়। একটা বড় কচু পাতা। তা, গ্রামে গঞ্জে অমন হার্বাল ছাতা বর্ষাদিনে সকলেই দেখেছে!
আমিও দেখেছি। আমাদের হরিপদই তো কত সময় মাথায় দিয়ে প্রাইমারি ইস্কুলে যেত। এই রে! হরিপদর কথা সেই এসেই গেল! এ এক অদ্ভুত জ্বালা! আশ্চর্য সমাপতন! ছাতা টানলেই হরিপদ যেন কোত্থেকে পাকা পোনার মত ঘপল ঘপল ঘাই মেরে ওঠে!
এই যে হরিপদ, এ কিন্তু সত্যিই ‘ সাদামাটা ছোট খাটো লোক’। এখনও, আড়াই যুগ আগেও।
যে সময়টার কথা এখন মনে আসছে, হরি তখন ক্লাস সেভেন। বলা বাহুল্য, আমিও তাই। মফস্বলের ইস্কুলে পড়ি। হরিপদর মজ্জায় মজ্জায় তখন ‘আষাঢ়’। ‘নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’-হরিপদ তাই যায়ও না! গেলেও ছাতা মাথায় যায়। আর আমাদের ওখানে তখন আকাশে মেঘ মানেই মাটিতে জল। সে জৈষ্ঠ হোক, বা শ্রাবণ- বৃষ্টি হল তো জল জমবেই। ছই ছাপা ছই, ছপাক ছই...কদম কদম জল ছিটিয়ে চলা। ডাঙায় এলেও বুটের ভিতর থেকে জমা জল পায়ের চাপে ফোয়ারা! মজাই মজা! বাদ কেবল হরিপদ! হাতে চটিজোড়া আর মাথায় লম্বা ডান্ডি দাদুর ছাতা! এমন ছাতা যে ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’ আগা গোড়া দৃশ্যমান। আষাঢ় মানেই হরিপদর হাতে ওই ছাতা, আর ওই ছাতা মানেই আষাঢ় এল। বন্ধুরা যে এ জন্যে ওকে কত বার ছাতাপদ বলেও ডেকেছে! কিন্তু হরি নির্বিকার। আলতো পায়ে জল ঠেলে ঠেলে বিড়বিড়ে বুজকুড়ির আলপনা পিছনে ছড়িয়ে সুবোধ হরি ধীর পায়ে হেঁটে গেছে বাড়ির পথে!
বর্ষার আদত মজা কিন্তু গ্রামে গঞ্জেই। শহরে না আছে দিগন্ত, না দিগন্ত ঝাপসা হওয়া তুমুল বরষণ। এ বাড়ির সান শেড ও বাড়ির চাল চোঁয়ানো জল শুধু হরদম। জল জমে ঠিকই, তবে তাতে যেমন আবর্জনা ভাসে, পাড়াতে মন চায় না। কেবল, বেরোতে যদি না হল, তবে ঘরে বসে জানালার পাশে আষাঢ়ের বৃষ্টি আর রেডিওতে আষাঢ়ে গল্প নয়তো গজলের সুর শুনতে বেশ লাগে। কিন্তু, গ্রামের আষাঢ় সত্যিই লাবণ্যময়ী! এক এক দিনে তার এক এক রূপ!
যে দিন আসে, মায়ার উচ্ছলতায় চারদিক হেসে ওঠে। সবুজের শোভা না হয় বাদই দিলাম, টুকরো টুকরো জমা জলে ডাহুকের লাজুক স্নান- সে ও কি কম? ঝপঝপিয়ে দুটো ডুব দিয়েই লুকিয়ে পড়ে নারকেলের গুঁড়ির পিছনে। ছুপি দিয়ে দেখে নেয় কেউ দেখছে না তো! নিশ্চিন্ত হয়েই ফিরে এসে ফের ডুব! অনাবিল আনন্দ! কত গপ্প, কত কবিতা, কত প্রবন্ধ, কত না ছবি! তাও অধরা থেকে যায় আষাঢ়ের সম্পূর্ণ রূপ। সে রূপের ছোঁয়া চেনে কেবল ছেলেবেলা। পুকুর ধারে নুইয়ে আছে বকুলের ডাল। বৃষ্টি হচ্ছে, এমন সময় সে ডালে উঠলেই দেখা যায়, কেমন করে ধোঁয়ার মত জল এসে মিশছে জলের বুকে। জলের কণার মতই ছেলেবেলাও তখন বাঁধন হারা- ঝপাঙ করে লাফিয়ে পড়ে...জলের মাঝে আকুল করা শীতলতা! সেই শীতলের কোনটি যে বরষার আর কোনটি পুকুরের তার বিভেদ করে সাধ্য কার? চোখে মুখে তখন কেবল আষাঢ়ের আদর, আর ডুব দিলে জলের উপর আষাঢ়িয়া নুপুরের ঝমঝম। আহা! সেই মোহময় ছন্দ যে শুনেছে, সেই মজেছে। যে শোনেনি, সেই হতভাগ্যকে না হয় অন্য কোন সময় স্মরণ করব।
এমন বর্ষার দিনে স্কুল যেতে হলে বর্ষাতি পড়তে হত। রেইন কোট। যে কোন ফেংশুই বিশেষজ্ঞ, নিশ্চিত, সেগুলোকে ঘাড় নেড়ে দুর্ভাগ্যের সূচক বলবেনই। উফ! কী সব রঙ! কচি কলাপাতা, নইলে পাকা সুপুরির মত গেরুয়া, নয় তো নয়ন তারার মত উজ্জ্বল বেগুনী! তায় মাথায় টুপি আর পিঠে উঁটের মত ব্যাগের কুঁজ। কুকুরের আর কী এমন দোষ! দেখলেই স্বাভাবিক মেজাজ সপ্তম। অমনি তড়বড়িয়ে তাড়া।
তাড়া বলে তাড়া! আছাড় না খাওয়া পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি নেই। আর আছাড় মানেই কাদা..সেই অজুহাতে ছুটি..অথচ জল ছড়িয়ে বাড়ি আসতে বেলা..আর বাড়িতে এলেই...থাক! সে কথা আর নাই বা বললাম, সবাই জানেন।
আরও একটু বড় হলাম যখন, মানে ওই নাইন- টেন হবে, ছাতা পেলাম। কিন্তু আসল কম্মটিকে বাদ দিয়ে সে ছাতার কত না কাজ! হকি খেলা, লেঙ্গি মারা, ক্লাস চলাকালীন খোঁচানো- এ সব তো আছেই। এমন কি ছুটির পরে ফিরতি পথে সেই ছাতা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জল ছেটানো! বৃষ্টি না এলেও তাকে ডাকা ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে’। ডাকবেনা? বৃষ্টি এলেই তো ছাতায় ছাতায় আষাঢ় বরণ! উপচে ওঠা খাল, বিল, বা নর্দমা থেকে মাছ ধরার নামে কাদায় জলে জল কেত্তন! আহা! কত সব সুনেহেরা পল!
তবে কেবল ছেলেরাই নয়, বড়রাও কিন্তু ছাতার অনেকই অপব্যবহার করত। ইস্কুলে, বাড়িতে যে ছাতাপেটা হত, সে কি অপব্যবহার নয়! তবে হরিপদকে কোনদিন ছাতাপেটা হতে হয় নি। হবেই বা কেন? ও তো আজন্ম মধ্যপন্থী। থার্ড বা ফোর্থ বেঞ্চের তিন নম্বর সিটে সবসময় চুপ করে বসে থাকত। আলাদা করে তাই কখনও চোখেও পড়ত না।
কী মুশকিল দেখেছ! সেই আবার হরিপদটা ঘুরে ফিরে এসে উঠছে!
অবশ্য আসবারই কথা! ছাতা হোক, আষাঢ় হোক, হরিপদর কথা আসবেই। ওর যে গোটা জীবনটাই বর্ষা। বাবা নেই। বাবার ভিটেটা কেবল আছে। আর আছে মা। দিদি বিয়ে হয়ে শহরে। ওদের বাড়ির অবস্থাও ওর মতই, না ভাল, না খারাপ। দালান বাড়ি, টালির চাল। ভিতরের দিকে চালের জায়গায় জায়গায় কৌটো বাঁধা। ঘর বাদ দিলে গাছ গাছালিতে ভরা ভারি সুন্দর ওদের জায়গাটা। রাস্তার একদম উপরেই। কতবার গিয়েছি!
কাকিমাকে একবার হরির এই মিয়ানো স্বভাব নিয়ে নালিশ করেছিলাম। কাকিমা বলেছিলেন, ‘ কী করবে বল, মাথার উপরের আসল ছাতাটাই তো ওর নেই!’
ছাতাও কিন্তু ভারি আশ্চর্য বিষয়! ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়! আবার ছাতা বদলালে মানুষটাও কেমন বদলে বদলে যায়! কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে তো লাল, নীল, গেরুয়া, সবুজ কত ছাতাই দেখলাম! ছাতার নিচে তরল মানুষও দেখলাম কত! সে যাই হোক, ইউনিভার্সিটির বর্ষা কিন্তু বেশ অন্যরকম। কালিদাসের বর্ষা বলা যায়। ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ এর মাহাত্ম্যটা এখানেই ঠিকঠাক মনে সেধোয়। বৃষ্টির টিপ টিপ অন্তঃকরণে দহন ধরায়। ‘পুড়ে যায় অধরোষ্ট’- শক্তি চাটুজ্জের বর্ণমালা ওড়ে বর্ষণে বর্ষণে। ‘শাওন বরষে, তরসে দিল..কিউ না ঘরসে নিকলে দিল...’!
সত্যিই বৃষ্টি এলে মন ঘর ছাড়া। আঙুলে আঙুল রেখে ভিজে যাওয়া। পায়ে জড়িয়ে আসে মৃত ঘাস। লেকের ধারে সার সার ছাতা..ছাতার ওই পারে সার সার বর্ষাধোয়া পা। আমাদেরও ছাতা আছে। খুলিনি। আষাঢ় মাখছি সারা শরীরে। বরণ করে ডাকছিঃ ‘ এসো আষাঢ়! নদী ভরিয়ে দাও। দুই পাড় থেকে ঝুপ ঝুপ ভেঙে যাক সঞ্চিত মাটি..’। আষাঢ়ই তো আমাদের একান্ত ছাতা। তাকে আড়াল করতে আরেকটি ছাতা! নৈব নৈব চ। সে করে তো করুক হরিপদ!
নাঃ!এবার সত্যি সত্যি জ্বালাল দেখছি!
জ্বালাতে সত্যিই পারে হরিপদ। গরমের ছুটিতে সেবার গেছি। স্বাভাবিক, হরির বাড়িতেও গেলাম। আগের দিনই কালবোশেখি হয়ে গেছে। সে তখন বাড়িতেই। সেই দাড়ি গোঁফ কামানো মিনমিনে মুখ। আলাদা করে ডেকে বললাম নিজের কথা। বললাম, ‘কী রে! তোর কি খবর? ভিজছিস নাকি কোথাও?’ উত্তর দিল না। বললাম, ‘নতুন একটা ছাতা বেরোচ্ছে জানিস? এক্কেবারে তোর জন্যেই। ছাতাটা নাকি আবহাওয়ার আগাম খবর দেয়। পাক্কা পাঁচদিনের! তোর মত সাবধানী মানুষের জন্যে একদম পারফেক্ট!’ জবাব নেই। ধুত্তোর! বললাম, ‘অদৃশ্য একটা ছাতা বেরিয়েছে রে হরি! চিনে। ছোয়াঙ ওয়াঙ না, কে একজন বানিয়েছে! শুধু একটা নল, বুঝলি? কোনো কাপড় টাপড় নেই। নলের বোতাম দাবালেই নিচ থেকে হাওয়া ব্লো করবে উপরে- ব্যস! বৃষ্টির ছিটে ফোঁটাও আর গায়ে লাগবে না! এই বেশ। জলও পড়বে, আড়ালও থাকবে না। এখানে এলে একটা নেব, তুই নিবি নাকি?’ এতেও চুপ! এতটা বেরসিক হল কবে? উঠব বলে নড়াচড়া করতেই হাতটা ধরল। বলল, ‘চল’। নিয়ে গিয়ে দেখাল রাস্তার ধারের বকুল গাছটার একটা ডাল। বড় একটা চাক হয়েছে সেখানে। বলল, ‘মৌমাছির ছাতাটা দেখ!’ রেগেমেগে বললাম, ‘তুই দেখ! হাঁদা কোথাকার!’
দিন পনের বাদে আষাঢ় এল। খবরও এল। শুনেই ছুটে গেলাম হাসপাতালে। বেডে শুয়ে শুয়ে হরি বলল মাস ছয়েক ধরেই নাকি চলছে এই তাণ্ডব! শুরুটা হয়েছিল শীতের গোড়ার দিকে। রাত সেদিন তখন প্রায় দশটা! শীতের মফস্বলে যথেষ্ট গভির। হঠাৎ ফট ফট...ফট ফট...কে রে? আমি! আমি কে? আমি
প্রোমোটার!
হরিপদ সাদামাটা ছোট খাটো কর্মী মৌমাছি। তাই ছাতা ওর
প্রাণ। স্বাভাবিক প্রতিরোধ। ক্ষমতা মত হুল। ফল স্বরূপ মৌলি প্রোমোটারের ধোঁয়ায়
বেধড়ক ধুম ধাড়াক্কা! কাকিমা যখন সেই সময়ের কথাগুলো ওখানে বসে বলছিলেন আমার রবি
ঠাকুরের কথাগুলো মনে আসছিলঃ ‘...উপরে উঠে চার দিক বেয়ে কালো মাথার কোন চিহ্ন দেখতে
পেলুম না- সমস্ত ফ্যাকাশে ধু ধু করছে। একবার বলু বলে পুরো জোরে চিৎকার করলুম- কন্ঠস্বর
হু হু করতে করতে দশ দিকে ছুটে গেল, কিন্তু কারও সাড়া পেলুম না। তখন বুকটা হঠাৎ চার
দিক থেকে দমে গেল, একখানা বড় খোলা ছাতা হঠাৎ বন্ধ করে দিলে যেমনতর হয়’। হরি বলল,
‘আমার ছাতাগুলো, জানিস, ঠিক ডোরেমনের ছাতার মত! আকাশের খসে পড়া তারা ওই দিয়ে ধরা
যায়, কিন্তু রাখা যায় না!’
হরিপদরা যেদিন চলে গেল, সে দিনও আষাঢ়। শনশনে হাওয়া।
ছাতার মত কালো মেঘ ছেয়ে। বৃষ্টি এল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। এই প্রথম ছাতা নিল না হরিপদ।
চিবুক দিয়ে গড়িয়ে এল আষাঢ়। ‘জলে নয়ন আপনি ভেসে যায়’!
বাড়ি ফিরে জানালা দিয়ে দেখলাম, ইউক্যালিপটাসের ধপধপে
গা বেয়ে ঘিয়ের স্রোতের মত আষাঢ়ের জল নামছে। মানিপ্ল্যান্টের চওড়া পাতা চুঁইয়ে
নামছে জল আর সেই পাতার নিচে দুটো ব্যাঙ, চারটে শালিখ। ছাতায় ছাতায় বর্ষা বরণ!
আসলে কি জানেন, গতকাল খবরে বলল, বর্ষা আসতে আর মাত্র
সপ্তা খানেক, আর পরশুই ডাকে একটা চিঠি এসেছে। নেমন্তন্নের কার্ড! কার্ডে লেখাঃ
‘শ্রীমান লোকনাথের শুভ অন্নপ্রাশন’। একটা ফুটফুটে গাবলা গোবলা বাচ্চার ছবি! নিচে
লেখা- ‘ তোমলা এস কিন্তু!’ তারিখঃ পয়লা আষাঢ়, স্থানঃ ছত্রধর ভবন, তেহট্ট, নদীয়া।
হরিপদর এই নয়া ছাতায় আষাঢ় বরণ দেখার জন্যে মনটা খুব
টানছে। খুবই। তেহট্টের দিকে ঠিক কোন কোন ট্রেন যায়, বলতে পারেন?
প্রকাশিতঃ কলকাতা 24x7.com (https://magazine.kolkata24x7.com/22-05-2016-arshinagar-saswata-kar/), 29.05.2016
copyright: Saswata Kar