Featured Post

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যা...

Sunday, December 31, 2023

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

 



শাশ্বত কর

 

 

 

বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যাচ্ছেন কি? যাচ্ছেন কোথায়? লাখ টাকার প্রশ্ন! বিজ্ঞানের এক উত্তর, শিশু ভোলানাথের এক উত্তর, গোঁয়ার গোবিন্দর এক উত্তর, বোদ্ধার এক উত্তর! ঘন রহস্য! অথবা কোনোই রহস্য নেই। কৃষ্ণ কেমন, না যার মন যেমন। জলে হাওয়ায় গেলাস ভরা ভাবলে ভরা, আধখানা খালি ভাবলে খালি। আসল কথাটা হলো আজ বছরের শেষ সন্ধ্যে। আজ হেব্বি সেলিব্রেশন! কোথাও জামাল কুদু, কোথাও লুটপুট গয়া তো  কোথাও দিন হ্যায় সানি সানি সানি-  চারপাশ থেকে নানা রকমের গান ভেসে আসছে। একের সুরে আরেক চেপে বসায় কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না মনে। এমনটাও ভালো। এতেও এক ধরণের নির্লিপ্তি আসে। নির্লিপ্তিই তো মুখ্য, নির্লিপ্তিই মোক্ষ।

আজ ভর দুপুরে ছাদে গিয়ে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছপালাগুলোর একটু পরিচর্যা করলাম। খালি দুটো টবে দুটো বীজ পুঁতলাম। একটা উচ্ছের আর একটা ঢেঁড়সের। এই দুটোই আসলে আজকের বর্ষ শেষের আমি। কাজের দুনিয়ায় যেমন তেঁতো, ঘরের দুনিয়ায় তেমনি ঢেঁড়স। তো দুই আমিকে বছর শেষে দিলাম পুঁতে। নতুন ভোরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে যদি। কচি অবস্থায় ছুঁচোর ছানাকেও মিষ্টি দেখায়। কাজেই সবুজ শাখে হলুদ ফুল না ফোটা অবধি উচ্ছে লতা অথবা ঢেঁড়সের গুল্ম দুটিই সুন্দর থাকবে। পুরোনো থেকে নতুন- খোলস বদলানো আর আশাবরী ছাড়া তো আর কিছুই না! ‘যাওয়া আসার এই যে খেলা চলছে হেথায় সর্বক্ষণ!’

আমার সাথে টুকাইও ছাদে গেছিল। আজ রোদ্দুরটাও ছিল ভারী মিষ্টি। ভর দুপুর, অথচ চাঁদি জ্বালানো না, বরং বেশ আরামদায়ক। বনভোজনের আদর্শ। মনে মনেই অবশ্য একথা বলেছি। নইলে বর্ষশেষের আদুরে আদিখ্যেতা মুহূর্তে গার্হস্থ্য গণ্ডগোলে বদলে যেতে পারত। পরিচিতরা সবাই বেড়াতে গেছে, দেয়ালে দেয়ালে সে সমস্ত ছবি টাঙানো, সেখানে মাঝদুপুরে ঘরের ছাতে বেড়াতে বেড়াতে হাতের চেটোয় বনভোজনের গন্ধ নেওয়া কজনের সহ্য হবে বলুন তো?

কথায় ফিরি, বর্ষশেষের দুপুরে আমার এক ইচ্ছা হলো। কুঁজোর চিৎ হয়ে শুতে ইচ্ছে করে, আমার উপুড় হয়ে শুতে ইচ্ছে হলো! গোটা গায়ে বর্ষশেষের এই সূর্য মেখে নিতে ইচ্ছে হলো! ইচ্ছে চেপে রাখতে নেই- ঠাকুরের কথা। কাজেই মনে মনে দুগগা বলে টুকাইয়ের শালখানা চেয়েই ফেললাম, বিতন্ডা ছাড়া দিয়েও দিল। সেইখানা ছাদে বিছিয়ে উদোম গায়ে শুয়ে পড়লাম। জোহানেসবার্গে এভাবেই কেউ হয়তো সানবাথ নিচ্ছেন। আমি না হয় যতীনদাস নগরে চারতলার ছাতে সূর্য মাখব। মন হো তো চাঙ্গা, তো কাটোরে মে গঙ্গা।

আকাশের নিচে না শুলে গোটা আকাশ দেখা যায় না। বিশাল আকাশ ! অনন্তের বোধ না জাগুক, খানিক যেন আঁচ মেলে। খানিক আকাশ চাইতেই চোখে ঝিলমিল লেগে গেল! অনন্ত দেখার চোখ কি আর সবার ! তা যা হোক প্রসাদ কণিকামাত্র পেলেও সৌভাগ্যের। পিঠে রোদের ওম, চোখে রোদের ঝিল মিল- কাত হয়ে শুতেই নিচের তলার প্রতিবেশীর ঘরের কথাবার্তা কানে এলো! আহা! ‘শীতল শীতল পরের কথা আসুক বন্ধু কানে!’ ব্যোমকেশ বক্সির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। এরকম ভাবেই একতলায় অনুকুলবাবুর বাক্যালাপ শুনেছিলেন ব্যোমকেশ। আমি ব্যোমে আমার অবশিষ্ট কেশ সঁপে দিয়ে পড়ে রইলাম। চোখের সামনে ছবির মতো ভাসতে থাকল গোটা বছরের নির্যাসচিত্রঃ

বর্ণময় বছর! ফুলে ফলে গন্ধে বর্ণে একেবারে রঙিন বছর! কত দেখলাম, কত ঠেকলাম, ঠেকে কত শিখলাম, শিখে কত ঠেকলাম, ফের…পুরো চেইন রিঅ্যাকসন! পাকা পোনার মতো ঘাঁই মেরে মেরে উঠল এক এক জন মানুষ! তাদের কত মুখ! কত রূপ! বিশ্বরূপ দর্শন! পার্থ প্রার্থনা করছেন, ‘হে কৃষ্ণ! যে রূপ দেখে অভ্যস্ত সে রূপেই ফিরে এসো হে!’- সে কি আর এমনি! অর্জুনের সহ্য হয়নি, আর আমি তো ছারপোকাস্য ছার! জেনাসের মত কারও দুটি মুখ, কারো আবার চতুর্মুখ, কেউ বা দশানন। দশমুখে তারা আরও দশ জনের কথা কইছে। আবার তার দশটি মুখের প্রতিটির কথা বুঝিয়ে যাচ্ছেন আরও দশ জন। শুনছি, বুঝছি, গিলছি না! গিলে করব কী! না পারি কইতে! কইলেই যদি বন্ধু ব্যাজার হন! অতএব না কওয়ার কষ্ট না সইতে পেরে না বোঝার ভেক ধরে নেই হয়ে থাকি!

ভেক- এইটেই অন্যতম সত্যি বলে বোধ হয়। এক, এক আর এক। ভেকটি বদলে বদলে কেবল এক থেকে এক কোটি। পুরোনো বদলে নতুন। একটা গল্প বলি-  ডাকসাঁইটে সুন্দরী কাকিমা। কী তার আলগা চটক! ফুলের পাশের ভোমরার মতোন গুণমুগ্ধরা ভনভন করে। বহুদিন দেখিনি তাকে, অন্য কোথায় বাড়ি করে চলে গেছিলেন। আক্কেল দাঁতের যন্ত্রণা সইতে না পেরে ডাক্তারের কাছে গেছিলাম যেদিন, সেদিন দেখি সেই কাকিমার মুখ হাঁ করিয়ে চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসা শেষে দেখলাম স্টিলের বাটিতে ঠকাং করে একপাটি দাঁত নামল। ডাক্তার দাঁত ঘষলেন। কাকিমা নামলেন। আমি রুমালে মুখ মোছার ভঙ্গী করে দেখলাম অমন ঢলঢলে মুখ দাঁত বিনে তুতলু পুতলু! সেই বাটির দাঁত যখন ফের পরা হলো খানিকটা ফেরত এলেন। আক্কেল দাঁত আমার আক্কেলে কিলো কষাল! বলল,  ভেক বদল আর বেশ বদল। পুরোনো হয়েছে এবার জামা বদলে নাও। নতুন জামার আনন্দে শিশুর মতো ফের খিলখিলিয়ে ওঠো, ফের ওঠো, জাগো আর হেঁটে যাও! হেঁটে যাওয়াই অনিবার্য। জামা বদলানোই অনিবার্য! নব নব রূপে হেসে ওঠো হে প্রাণ। বিজ্ঞান বলেছেন, কিচ্ছুটী ধ্বংস হওয়ার জো নেই, তৈরি হওয়ার জো নেই। বস্তুতে শক্তিতে, পুরুষে প্রকৃতিতে মিলে যতখানি ছিল তাই থাকবে। শুধু রূপ বদলাবে , বেশ বদলাবে আর নতুন উঠবে হেসে। গীতাও বলেন,

“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়

নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।

তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা-

ন্যনানি সংযাতি নবানি দেহী”

এ শরীর সব শরীর। সর্বভূতে ছড়িয়ে থাকা আত্মা। নতুন বসনে তার নতুন লীলা। তার নতুন কোনো রূপ দেখছে তাঁকেই। জটিল ধাঁধা, অথচ সহজ উত্তর!

গীতার কথা বললাম বটে , কিন্তু উচিত হলো না। গীতাকে এখন দর্শনের গণ্ডী ছাপিয়ে অন্ধত্ব ছড়ানোর হাতিয়ার করতে চলেছেন কেউ কেউ। নির্লিপ্তির আকরকে ক্ষমতার বাঁধন দেওয়ার দড়ি করতে চাইছেন কেউ কেউ। ‘সম লোষ্টাশ্ম কাঞ্চন’- পাথর, ছাই আর সোনায় সমজ্ঞান শেখানোর গ্রন্থটিকে কোষাগারের চাবি বানাতে চাইছেন কেউ কেউ। সুখে, দুখে, শীতে, গ্রীষ্মে , প্রিয়ে অপ্রিয়ে সমজ্ঞান- গীতায় এই মহান শিক্ষা  করে স্থিতপ্রজ্ঞ, সর্বত্যাগী হওয়ার ভেক ধরে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছেন কেউ কেউ। সব বুঝেও গীতার কথা উচ্চারণ করা বোধ হয় তাই ঠিক হলো না। অবশ্য লোকে বলে সময় বদলালে  সব বদলায়। বদলায় কি আদৌ? এই যে যেখানে সেখানে যে কোনো দলের মানুষ ইদানিং কেবল ভোট রাজনীতিকে সামনে রেখে গীতার ব্যবহার করছেন, পাঠ করছেন করাচ্ছেন, গ্রন্থগীতা কি নিজে তাতে মত দেন?

“ইদং তে নাহতপস্কায় নাহভক্তায় কদাচন।

ন চাহশুশ্রূষবে বাচ্যং ন চ মাং যোহভ্যসূয়তি”

তপস্যাহীন ব্যক্তিকে গীতাশাস্ত্র বলবে না। ভক্তিহীন ব্যক্তিকে গীতাশাস্ত্র বলবে না। শুনতে চায়না এমন কাউকেও বলবে না। অবিশ্বাসীকে বলবে না। কেবলমাত্র ঈশ্বরে অসূয়াশূন্য, তপস্বী ভক্ত ও শুশ্রূষু ব্যক্তিকেই গীতাশাস্ত্র বলবে।

কে শোনে কার কথা! সবই তাঁর রূপ। সবই তাঁর লীলা! তিনিই গড়েছেন, দরকারে তিনিই তো ভাঙবেন! এই তো স্বাভাবিক নিয়ম।

এই যে লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, আমার তো বেশ মনে হচ্ছে রাত পোয়ালেই লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে খলবলিয়ে শিশু সূর্য উদয় হবেন। গোঁফের রেখা উঠতে তার আবার ছ’মাস কেটে যাবে। ছ মাস বাদে যুবক সূর্য। তারুণ্যের প্রেম তার তখন মেঘের সাথে। লুকোচুরি, খুনসুটি, হাসিকান্নার সাক্ষী হবে পৃথিবী। সেখানেও চলবে জীর্ণ জামা বদলের খেলা। পাতা ঝরবে, ফুল ফুটবে, ভোমরা গান গাইবে। আলোর কাছে প্রার্থনা চলবে নতুন বছর মানবিক হোয়ার। ‘আরো আলো আরো আলো এই নয়নে প্রভু ঢালো’। চেইন রিঅ্যাকশন বলবেন কেউ, কেউ বলবেন থার্মোডিনামিক্সের ফার্স্ট ল, কেউ বলবেন নিত্যতা সূত্র, কেউ বলবেন গীতা, কেউ গ্রন্থসাহেব, কেউ কোরান, কেউ বাইবেল। আদতে একজনই থাকবেন, একজনই হাসবেন রূপ বদলে বদলে। বদলের এই লীলায় তাঁর মেতে উঠবেন তিনি নিজেই। মেতে উঠবেন ব্রহ্মাণ্ড। ইয়ৎ পিণ্ডে তৎ ব্রহ্মান্ডে!  

Tuesday, November 21, 2023

এসো মা, এসো মা উমা

 শাশ্বত কর



সুপ্তপর্ব

“যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে!

গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!”


ঠাকুর দালানে ধুনুচি সাজানো হচ্ছে। এও এক শিল্প! নারকেলের ছোবড়া উল্টো করে এমন করে সাজা হবে যে ধুনুচি নিম্নমুখী হলেও সহজে পড়বে না! নইলে আরতি জমবে কেমন করে! 

ছোবড়া চুঁইয়ে ধোঁয়া মিশছে বাতাসে। বাতাসে ধুনোর গন্ধ! বাতাসে কর্পুরের গন্ধ! বাতাসে শিউলি, ছাতিম, বাতাবি ফুলের গন্ধ! বাতাসে ঠান্ডা আদর! আদর আমার গালে। মায়া আদর, আচ্ছন্ন আদর। যে সুগন্ধী বাতাস নাকি গোলাপের মৃদু পাঁপড়ি এই আদর এঁকে গেল, এই তো খানিক আগে যখন তেতলার চক বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচে ঠাকুরদালানের পাশে রাঙাপিসিমাদের আড্ডা দেখছিলাম, তার নাম এখানে লেখার কীই বা দরকার? গতকাল সকালে পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা সেই আমায় দিয়েছে, ভিড়ের অছিলায় আঙুল ছুঁয়ে গেছে। কাছে আসলেই মায়ের পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা আমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক পুব বাগানের বাঁধানো বেদির পাশে রাত আলো করে থাকা নিশিপদ্মের মতো! এ গন্ধের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা! এখন যেমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি চক বারান্দায়। হাতে শ্রীশঙ্খ!

ঠাকুর তোরঙ্গ থেকে বড় শাঁখখানা আনতে পাঠিয়েছিলেন রাঙাপিসিমা। সারা গায়ে কাজ করা সোনা বাঁধানো এই শাঁখটা আমার খুব প্রিয়! কেবল নবমীর সন্ধ্যেতেই এই শাঁখ বেরোয় তোরঙ্গ থেকে। গেল বছরও লম্বায় আমার এক হাত ছিল। এ বছর আমার কবজি ছুঁয়েছে। এবার বাইরে থেকে যত আত্মীয় এসেছে, সবাই বলছিল আমি নাকি বেশ ঝাড়া দিয়েছি। নাকের নিচে সরু গোঁফের রেখাটা বাদ দিলে মুখখানা নাকি আরও মায়ের মতো হয়ে উঠেছে।

মা! শব্দটা বললেই পুজোর সময় আমার চোখে জল আসে। তখন ক্লাস ফোর- বিজয়া দশমীর ভোরের আলো ফুটছে- মাকে নিয়ে সবাই চলে গেল। মা দুর্গা তখনও ঠাকুর দালানে- মা চলে গেল! রাঙাপিসি ডান হাতে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বাঁ হাতে আমায় বুকে টেনে বলল, ‘মা আজ তোর বাবার কাছে গেল রে!’ ফুলদাদু সন্ধ্যেবেলায় দুর্গামাকে দেখিয়ে ধরা গলায় বললেন, ‘ওই তোমার মা!’

তারপর ন’বছর পেরিয়ে এবার দশ। মা এসেছে। পুজোর ভিড়ে মাকে কাছে পাই না। আগেও অবশ্য পেতাম না পুজোর দিনে। মা, ছোটমা, সোনামা- সবাই তো সেই মহালয়ার আগে থেকেই গোছগাছে লেগে যেত। রাঙাপিসিমা নিয়মকানুন বলে দিতেন। আমাদের পুজোর তো আবার হাজারো নিয়ম। দাদুরা সবাই বলেন- দুর্গামা না কি এ বাড়ির মেয়ে। কৈলাশ থেকে বাপের বাড়ি আসে। তাঁকে আনার জন্য তাই শ্বশুরবাড়িতে নেমন্তন্ন পাঠাতে হয়। নেমন্তন্নর চিঠি লেখা হতো সব দিদিদের শ্বশুরবাড়িতে। আর দাদুর উমা মায়ের নেমন্তন্নের জন্য দুপুর হলেই হতো চন্ডীপাঠ, আর সন্ধ্যে হলেই আগমনী গান। ফুলদাদু গাইতেন, নীলুদাদু গাইতেন, ঝড়োদাদু গাইতেন, রাঙাপিসি, ন’পিসি, বুলা পিসি, মা গাইতো- সে এক অদ্ভুত মায়ার আসর! মায়েদের আরও কত কাজ! পুজোর বাসন কোসন, মায়ের গয়নাগাঁটি, শাড়ি, আলতা, সন্দেশের সঞ্চ, নারকেল, চিনি, ঘি, মধু- আরও কত কী- সব সপ্তমী অষ্টমী নবমীর হিসেবে গুছিয়ে নেওয়া! পুজো শুরু হলেই তো শেষ! তখন কী আর তাল পাওয়া যাবে অত মানুষের ভিড়ে!

নীচ থেকে রাঙাপিসি দেখে আমায় হাত নেড়ে ডাকছে। শঙ্খটা নিয়ে যেতে হবে! রাঙাপিসির পাশে যে দু’জন এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের খেয়াল আমি দাদুর সাথে আমি টিভিতে দেখেছি। আজ নবমীর গান তা হলে ওঁরাই গাইবেন।

ছোটকাকু বড় শাঁখে তিন বার ফুঁ দিতেই ঢাকে কাঠি পড়ল। আরতির বাজনা। দীপ, ধুপ, বস্ত্র, পুষ্প, চামর দিয়ে আরতি চলল। মায়ের চোখ জ্বল জ্বল করছে। আমারও চোখ জ্বালা করছে। আজই তো শেষ। চোখে দেখতে পাওয়া, পা ছুঁয়ে প্রণাম করার মা যে আবার চলে যাবেন এক বছরের জন্য।

মা চলে যাওয়ার পর থেকে আমাদের এ বাড়িতে বিসর্জনের বাজনা বাজে না। নবমীতেই যা পুজো। দশমীর পুজো তিথি মেনে হয়, ঢাক বাজে না। দর্পণে বিসর্জন। পুরোহিত দক্ষিণা। ঢাকিদের বকশিস। সব সেরে কাকু আর দাদারা নিঃশব্দে দুর্গামাকে নিয়ে যান গঙ্গায়। ফুলদাদু এসে আমার হাত ধরে বলেন, ‘মা তো এখন থেকে সব সময় তোমার সঙ্গে থাকবেন দাদা। বিসর্জন তো চলে যাওয়া নয়। মায়ের মিশে যাওয়া তাঁর সৃষ্টিতে। চিন্ময়ী মা। মৃন্ময়ী মা আবার আসছে বছর আসবেন বাড়িতে!’

কাকিমার সাথে দিদি, বোনেরা মিলে বিজয়ার জন্য হলঘর সাজাবে। সেখানে সবাই বসবেন সন্ধ্যে হলে। প্রণামে, আলিঙ্গনে, মিষ্টিতে ভরে উঠবে বিজয়া। রাঙাপিসিমা বলবেন, ‘আগে এ বাড়িতে বিজয়ায় ভিয়েন বসত। আশু ময়রা কুলিয়ে উঠতে পারত না মিষ্টি বানিয়ে। তার সঙ্গে নাড়ুবড়ি, ক্ষীর- বিজয়া মানে সে এক এলাহি কারবার! ঢাকি, কুমোর পরিবার থেকে শুরু করে যত জ্ঞাতিগুষ্টি-সবাই আসতো। ধম্ম কম্মেরও বাছ বিচার ছিল না এ বাড়িতে। হিন্দু, মুসলমান, সাহেব সুবো- সবাই নাকি এসে মিষ্টিমুখ করত, পাত পেড়ে খেত এক সময়! বিজয়া তো নয়, সে যেন এক মিলনোৎসব!’

নীচে যেতে যেতেই ফুলদাদু পথ আটকালেন। টুকটুকে হাত ভর্তি পোস্টকার্ড! দাদু এখনও নিজে বিজয়ার পত্র লেখেন। আমাকেও লিখতে হয়। সবার আগে মাকে লিখতে হয়- 

“শ্রীচরনেষু মা,

ঁবিজয়ায় আমার প্রণাম নাও! আশা করি যাত্রা শুভ হয়েছে। আমি ভালো আছি। রাঙা পিসি, ফুল দাদু- সবাই আমায় খুব ভালোবাসে। তুমি আমার চিন্তা কোরো না, ভালো থেকো। আসছে বছর আবার এসো মা গো!”

বিজয়ার সন্ধ্যায় আমি লিখব আর ফুলদাদু দেখবেন। দেখতে দেখতে ফুলদাদুর মুখ লাল হয়ে যাবে, তবু কাঁদবেন না! যদি আমি কাঁদি!


আদিপর্ব

“তিনদিন স্বর্ণদ্বীপ জ্বলিতেছে ঘরে

দূর করি অন্ধকার;……”



ওপরে যা সব লেখা পড়লেন, হে সুজন পাঠক, করজোড়ে মার্জনা চেয়ে বলি- রীতিনীতিগুলো ছাড়া সে সব কোনোটিই সত্যি নয়। রীতিনীতিগুলো যা অল্পবিস্তর আছে সে আমার পাঠলব্ধ অভিজ্ঞতা বই আর কিছু না। আমি আসলে এরকম ভাবতে ভালোবাসি। যদি এই নির্দেশতন্ত্রে না থেকে আমি নামক শরীরটি ওই নির্দেশতন্ত্রে থাকত তবে ঘটনাক্রম ঠিক কেমন কেমন হতো- সে সব ভাবতে আমার বেড়ে লাগে! কখনো হাসি পায়, কখনও চোখ ভেজে। এ অভ্যেসের মেলা সুবিধা আছে। যে সব দৈনন্দিন জ্বালাযন্ত্রণা নিম্নমধ্যবিত্ত নামক যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁত চিপে সহ্য করতে হয়, আমার ওই অভ্যেসটি সে সব বিন্দুমাত্র স্থায়ী হতে দেন না। এই যে যেমন খানিক আগে বাড়িতে মা ঠাকুমার এক চোট হলো! প্রায়ান্ধকার গলির ঘ্যাঁষ ছড়ানো রাস্তা- সবুজ টিউবের আলোর পাশে সাইকেল ঠেকনা দিয়ে মাইকে কুমার শানুর পুজোর গান শুনতে শুনতে একা একা বেশ ভাবছিলাম। তারপর ভাবনাটা একটু বেলাইনে চলে যেতেই মায়ের মুখটা ভেসে উঠল, আর আমিও বর্তমানে ফেরত চলে এলাম।

আজ নবমীর রাত। কাল দশমী। গৌতমের মার থেকে তিনটে নারকেল কেনা হয়েছে। গৌতম আমার বন্ধু বলে কাকিমা দুটো ফাউ দিয়েছে। মা আর ঠাকুমা পারস্পরিক কচকচির মধ্যেই ট্রাঙ্ক থেকে বাসন কোসন বার করছে দেখে এলাম। এবার তেঁতুল বেরোবে। ঝকঝক করবে বাসন কোসন রোদ নিতে নিতে। আগামীকাল সকালে বাবার সাইকেলের ডান হ্যান্ডেলে ঝুলতে ঝুলতে আখের গুড়, চিনি, বাতাসা, মঠ, মিশ্রি আসবে। বাম হ্যান্ডেলে থাকবে পুজোর ফুল, পল্লব, ঝরামালা, আর শোলার কদম। সাইকেলের একদম সামনে হুক থেকে ঝুলবে মাছের থলের ভিতর জোড়া পুঁটি।

দশমীতে যাত্রা ঘট পাতা হবে বাড়িতে। কেন যেন মনে হয় এ রীতি দুর্গাপুজোর সংক্ষিপ্ততম রূপ। আমরা ওপার বাংলা থেকে তাড়া খেয়ে আসা বাঙালী। আমরা মানে আমার বাবা, মা- ঠাকুমা। আমার জন্ম অবশ্য এদেশেই। সে যাই হোক, মনে হয় কোনো পুরুষে হয়তো বাড়িতে দুর্গাপুজো হতো, তারপর অবস্থা পড়ে গেছে- আর হয় না। সংক্ষিপ্ততম রূপ হিসেবে বারোয়ারি মন্ডপে মহাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি, মায়ের বরণ আর গৃহে মায়ের শুভযাত্রার প্রার্থনায় যাত্রাঘট পাতার রীতিটি কেবল আছে। 

পুজোর ঘরে মা বসবেন ঘট সাজিয়ে। বাড়ির সামনের স্থলপদ্ম গাছে কাল ঝেঁপে আসবে গোলাপি ফুল। ঘটে সাজবে সিঁদুরের ফোঁটা। ঘটের পাশে সিঁদুরের ফোঁটায় সাজবে জোড়া পুঁটি। নব সাজে পুঁটিকে তখন দেখতে লাগবে কচি ইলিশের মতো। আর এক পাশে নাড়ু, তক্তি, ক্ষীরের সাঁচে, মঠে, মুড়কিতে ভরে থাকবে পাত্র। দূরে মেঝের ভাঙা খাঁজে অপেক্ষা করবে কালো পিঁপড়ের দল! শোলার কদমে পড়বে সিঁদুরের ফোঁটা। দরজার শিকলের খাঁজে পুরোনো সরিয়ে নতুন কদমের সুতো বাঁধবে বাবা। শিকলের নিচে দরজার কাঠে সিঁদুরের ফোঁটা দেবে মা। সিঁদুর খেলা হবে মন্ডপে। দুর্গা মায়ের সামনে থাকবে কাঠের হাই বেঞ্চ। বেঞ্চের উপরে উঠে মায়েরা বরণ করবেন মাকে! মায়েদের মুখ আর মায়ের মুখ তখন এক। মায়েরা পান দিয়ে বরণ করবেন , সন্দেশ খাওয়াবেন, জল খাওয়াবেন সসন্ততি, সবাহন মাকে। তারপর মায়ের সামনেই মায়ের মত করে সিঁদুরে রাঙাবেন নিজেদের। এ সিঁদুর খেলা মনে হয় বিজয়োৎসব। মায়েদের বিজয়োৎসব। ন’ দিন ন’ রাত ধরে লড়াই শেষে মহিষাসুরমর্দিনী মায়ের বিজয়োৎসব। রোজ রোজের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মায়েদের যন্ত্রণা হারানোর বিজয়োৎসব। পার্থর মা, গৌতমের মা, রুমকির মা, টুপাই-এর মা আর মহিষাসুরমর্দিনী মায়ের এক হয়ে যাওয়ার বিজয়োৎসব। এসব অবশ্য আমার ধারণা। সঠিক আমি জানি না। জানেন হয় তো পন্ডিতরা। কোনোদিন পন্ডিত হতে পেলে আমিও জানব।

বরণ শেষে মা আসবেন। প্রণাম করব মাকে। ছোট প্যাকেট থেকে লাল হয়ে যাওয়া সন্দেশের একটা কোণা ভেঙে আমায় দেবেন। প্রসাদ। ফুল দেবেন। আশীর্বাদ। বইয়ের মাঝখানে যাবে ফুল। আশা। ঠাকুমা মাকে বকবেন। বিজয়ার নাড়ুবড়ি মিষ্টি সাজাতে বলবেন। রোজনামচা।

সন্ধ্যে হতেই পাড়ার কাকু কাকিমারা আসবেন। মোড়ায় বসবেন। চেয়ারে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হবে। সোফাটা আরেকটু বেঁকে আপত্তি জানাবে। বাবা হাসিমুখে আপ্যায়ণ করবেন। আলমারির পাশে ঢোলা হাফশার্ট- হাফপ্যান্টে সাজব আমি। স্টিলের প্লেটে সেজে উঠবে গুড়ের নাড়ু, চিনির নাড়ু, তক্তি, ক্ষীরের সাঁচ, গজা, মিহিদানা, মুড়কি আর কুচো নিমকি। খাওয়ার আগে প্রণাম হবে , আশীর্বাদ হবে, কোলাকুলি, আলিঙ্গন হবে। বিদায়ের শেষে তাঁদের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবেন। রাত দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত অতিথি আসবেন। আশেপাশের বাড়িতে বিজয়ার মিষ্টি দেওয়ার জন্য থালা সাজিয়ে দেবেন মা। অন্ধকার দেখে ঢাকা তুলে সেখান থেকে দু’ চার পিস হাপিস করে দেব মিচকে ভালোমানুষ আমি। যার বাড়িতে যাব, সেখানে প্রণাম সারার পর ওই থালাই ফের ভরে উঠবে তাদের বাড়ি থেকে। আমার জন্য আলাদা করে প্লেটে আসবে গজা, দানাদার, নিমকি নয়তো ঘুগনি। সে বাড়ির থুত্থুড়ে ঠাকুমা বাবার কথা জিজ্ঞেস করবেন, ঠাকুমার কথা, মায়ের কথা জিজ্ঞেস করবেন। খেতে খেতে আড় চোখে দেখব সে বাড়ির পুঁচকি খাটের পাশ থেকে ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে হয় তো ইশারায় বলছে, ‘বলব? বলব?’ 

এ সব চলবে আরও কয়েক দিন। এ পাড়ায় ও পাড়ায় বিজয়া সম্মিলনী হবে। এ সবের মধ্যেই একদিন ফাঁকা বিবিধভারতীর দুপুরে বিছানার তলা থেকে ইনল্যান্ড লেটার আর পোস্ট কার্ড বের করবে মা। মেঝেতে বসে নিজেই লিখবেন-

শ্রীচরণেষু মা,

তুমি আমার ঁবিজয়ার প্রণাম নিয়ো। দাদা, বৌদিদের আমার প্রণাম জানিয়ো। পুলককে আমার ভালোবাসা দিয়ো। রাজু, মিঠু, মালা, মানু, তাপুদের আমার স্নেহাশীষ দিয়ো। আমরা একপ্রকার কুশলেই আছি। ……

লেখার শেষে খানিকটা জায়গা আমার জন্য বরাদ্দ। আমায় ডেকে সেখানে লেখাবেন, 

দিদা আমার ঁবিজয়ার প্রণাম নিয়ো। বড়মামা, মেজমামা, ছোটমামা আর সব মামীদের আমার আমার ঁবিজয়ার প্রণাম জানিয়ো। দিদি, দাদা, ভাই…

বিবিধভারতী বাজাবে অনুরোধের সুর- ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া!’


সমাপন পর্ব

“বার মাস তিতি, সত্যি, নিত্য অশ্রুজলে, 

পেয়েছি উমায় আমি”


ডায়েরিটা খুঁজে পেয়েছি শ্বশুরবাড়ির দেড়তলার ঘরে। আমারই সুপ্ত ইচ্ছা গুপ্ত কথার হিজিবিজি ভরা ডায়েরিখানা পারিবারিক সেফটি রিজনে দিয়ে রেখেছিলাম একদা বন্ধু অধুনা গিন্নির সেফ কাস্টডিতে। সে প্রায় বছর উনিশ কুড়ি আগে। তারপর তিনি রেখেছিলেন তাঁর ট্রাঙ্কে। তারপর বিয়ে থা, চ্যাঁ ভ্যাঁ, দায়িত্ব, কর্তব্য, কাগজ কলমের ধুলোঝড়ে সে সব মাথা থেকে কবে বেরিয়ে গেছে। মাথা থেকে ইচ্ছে টিচ্ছে সব গুটিয়ে গিয়ে সেখানে পতপত করে উড়ছে ট্রেন্ডি দিনকাল। সবই সমাজ। কারা যেন সমাজ বদল চেয়েছিল, চালাক চতুরদের সুকৌশলী ঘুঁটি বদলে সে বদল এমনই ট্র্যাজিক হলো যে তারাই একেবারে একঘরে হয়ে দাঁড়াল। ঠিক যেন একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত- যাদের এখন খুঁজেই পাওয়া যাবে না। হুসহুসিয়ে উড়ছে উন্নতির ধ্বজা। হুড়হুড়িয়ে দৌড়চ্ছে রথ। বেশভূষায় তো নয়ই, বাসস্থানে খানিক খুঁজে পেলেও রীতিনীতিতে ততটা আর মিলবে বলে আমার মনে হয় না। না মেলাই ভালো। সর্ব মঙ্গল ভব! সার্বিক উন্নতি ইজ আওয়ার উন্নতি! উন্নতির বিপক্ষে যারা তারা হয় বুদ্ধু নইলে জেলাস!

হেঁইয়ো! ট্র্যাকে ফিরে এসো বস!

এই হয়েছে ইদানিং। উন্নতির রথে চেপেছি ঠিকই, দৌড়চ্ছিও- কিন্তু স্বভাব যায় না মলে! মাঝে মধ্যেই উড়ুউড়ু মন, কুলুকুলু জল, ঢুলুঢুলু চোখ! মন গাছ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে, আশপাশ ছাড়িয়ে, উঁকি দেয় আকাশে। চিদাকাশ। শূন্য। ধূসর। যেটুকু দাগ ছাপ আছে তাও অনেক হালকা। ছাড়া ছাড়া কাশের রেণুর মতো কচি তুলোট মেঘ। অবকাশ নামক প্রায়াবলুপ্ত শব্দের সম্মুখীন হলে সে সব তুলোর মেঘ ভিড় করে আসে। গাছপালা, মাকড়শা, ব্যাঙের ছাতা, আলোকলতা, কচু, ঘেচু, অর্কিড, নারকোল, হাঁড়িচাচা, বেজি- নিরিবিলি এই মরুদ্যান- এমন অবস্থা গাঢ় হওয়ার ক্যাটালিস্ট, মাইকে ভেসে আসা পুজোর মন্ত্র আর হঠাৎ পাওয়া ডায়েরিটা হলো ক্যাটালিস্ট প্রোমোটার।

মনে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে স্মৃতি। অশোক, বকুল আর কৃষ্ণচূড়া ছাওয়া বিতানে বিকেলে সন্ধ্যায় পায়চারি করতে করতে মন সরে যাচ্ছে বর্তমান থেকে। মশার মতো দু পায়ে তেড়ে কামড়ে যাচ্ছে বর্তমান। মোবাইল ফোনের মতো সুইচ অফ করে দিয়েছি বর্তমান। মা আছেন তিনদিন! কলার উঁচু আমার! কী করার আছে করে নে!

নবমীর রাতে দূরদর্শনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডিং দেখিয়েছে। দোতলার প্রায়ান্ধকার বারান্দায় বসে বসে শুনেছি। লিচুর ঘন পাতায় অন্ধকার থুবু। কালো ডানা মেলে রাতপাখির উড়াল। মাইকে মহানবমীর মন্ত্রোচ্চারণ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন- 

নবমী নিশিরে তোর দয়া নাইরে

এত করে সাধিলাম

তবু হইলি ভোর

হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে? কখন মনপাখি সেই ডায়েরির পাতা ছুঁয়ে উড়ে বনেদি বাড়ির অচেনা মা হারা ছেলের জন্য চোখ ভিজিয়ে দেয়। বাবার সাইকেলের ঘন্টিতে জোড়া পুঁটিমাছের দাম শুনতে পায়!

আসলে মা এ’জন্যেই বছরে বছরে আসেন। মা আসার আগে গেরস্তের ঘরের ধুলো ঝাড়া হয়। মায়ের কাছে চারদিনে মনের ধুলো ধুয়ে যায়। মা ছাড়া যে সন্তান হেলা ছেদ্দায় এপাশ ওপাশ ধাক্কা খায়- মা কি তা জানেন না? জানেন বলেই আসেন। কোটি সন্তানের কোটি দুঃখ, কোটি সাধ। যশো দেহি, আয়ুর্দেহি…. দাও, দাও, দাও মা! দেওয়ার জন্যেই তো তুমি মা। নিঃস্বার্থভাবে শুধু দেবে। হাত পেতে কেবল নেব। জন্মদাত্রী মায়ের থেকে নেব, আশ্রয়দাত্রী মায়ের থেকে নেব। তুমি তো সবার মা- তাই তোমার থেকেও নেব। চেয়ে নেব, কেঁদে নেব, চেঁচিয়ে নেব। তারপর ভুলে যাব। রাস্তায়, ঘরে, কাজের জায়গায় সবখানে তোমার অপমান অসম্মান দেখেও মুখ টিপে চুপ করে থাকব। পুজোর আগে তোমায় অসম্মান করা অসুর ছাড়া পাবে, তার দাদা অসুর আরও বড় স্তরে বকধার্মিক হয়ে দাপাবে- সবখানে চুপ করে থাকব। তুমি তো মা। সন্তানের অক্ষমতা, ক্যালাসপনা ঠিক ঢেকেঢুকে সমৃদ্ধিতে ভরে দেবে। সমৃদ্ধি পেলেই তোমায় হাওয়া করে দেব! তোমার তিথিসম্মত বিদায় নেওয়ার আগেই মোবাইল খুলে সবার আগে ‘শুভ বিজয়া’ পোস্টাব- ভার্চুয়াল মিষ্টিমুখ- ভার্চুয়াল আশীর্বাণী! উন্নতির জয়রথে টপ টু বটম- আনন্দ হি কেবলম!

তবে ভয় হয়! পুজো মন্ডপে চেয়ারের উপর চেয়ার তুলে যখন তোমায় বরণ করে, তখন তোমার মুখ, গিন্নির মুখ, মায়ের মুখ এক হয়ে যেতে দেখে ভয় হয়। সিঁদুর খেলায় রেঙে ওঠা গাল, তোমার শক্তি চুঁইয়ে আসা চোখ দেখে আশা জাগে! নিশ্চয়ই ঝলসে উঠবে বজ্র, তীব্র ঘূর্ণনে ঘুরবে সুদর্শন চক্র- তোমার দশ হাতের অস্ত্র মাটির মায়েদের কোটি হাতে। যুথ সোচ্চারে আকাশ বাতাস কাঁপবে! হাঁটু মুড়ে বসবে অসম্মানের অশুভ। থর থর কাঁপবে। তোমাদের সেই শক্তির পাশে নতজানু হয়ে ভিক্ষা করবে বকধার্মিক- দেবী দুর্গা প্রসীদ! 

অপেক্ষা করে থাকি মা গো! কবে ওই তীব্র ত্রিশুল ভেদ করে যাবে মর্ম আমার! সব পাপ, সব পুণ্য, সব যশ, সব দর্পর বিসর্জন হবে দর্পণে! চিদাকাশে অসুর দলনী মায়ের বিজয় সুরে ভেসে উঠবে বিজয়া। বিজয়োৎসবে মিষ্টিমুখ করিয়ে মায়ে পোয়ে এক হয়ে যাব আকাশে বাতাসে। তবেই না শিউলির সারল্য ভরা এই মনে ফুলদাদু ফের তোমার প্রতিমা দেখিয়ে বলবেন, ‘এই তোমার মা!’ তবেই না পুজো শেষে সসন্ততি কন্যা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কালে মা বলবেন ‘যাই বলতে নেই, বল আসি!’ দেবী মা মিলে যাবেন পার্থীব মায়ের আসনে। বাতাসে ধ্বনিত হবে মায়ের সকরুণ সুর-

“এসো মা, এসো মা উমা

ওমা বোলো না তো যাই যাই

মায়ের কাছে হৈমবতী

ও কথা তো বলতে নাই!”

--ঃ--

প্রকাশিত- আজকাল.ইন, রবিবার অনলাইন , 29.10.2023


Monday, September 18, 2023

একটি ভোকাট্টা হওয়া ঘুড়ি আর সম্মোহনের কল

 



শাশ্বত কর


চেত্তা খেতে খেতে সবুজ-সাদা একটা লাট্টু ঘুড়ি এসে ঠোক্কর খেল ছাতে। অনেক সুতো। হাতপাট্টি করতে করতে হাত ধরে এলো যেন। নিজের মনেই হাসছিলাম। ছোটবেলার অভ্যাস- ঘুড়ির থেকেও সুতোর টান বেশি। পকেটে খাবলা খাবলা হাতপাট্টি করা মাঞ্জা। ঘুড়ি, সুতো কোনোটাই তো কেনার উপায় নেই! অবশ্য তাতে সমস্যা তেমন কিছু না। ঘুড়ির ধর্মই সুতো কেটে ভাসতে ভাসতে নতুন কোনও ঠিকানায় গিয়ে ওঠা। কাজেই ভোর ভোর হাঁটলেও গতকালের শেষ বিকেলের কাটা খাওয়া দু’ একটা ঘুড়ি মাঠে , উঠোনের কোণে নয় তো গাছে বাঁধা অবস্থায় মিলে যাবেই। কিন্তু সুতো তো আর সবসময় ওভাবে মেলে না! হাত্তা দিলে মেলে বটে, তবে তাতে যে পরিমাণ গাল শোনার সম্ভাবনা, তাই সে বেলতলায় আর যাই না! অতএব- 


যেখানে দেখিবে সুতা,

দু আঙুল ঘুরাইয়া গুটা,

গিট্টু বাঁধিলে তায়,

লাটাই ভরে মাঞ্জায়!


হাতপাট্টি করা সুতোর গোছটা ছাতের মেঝেয় নামিয়ে রেখে ঘুড়িটা হাতে নিলাম। কড়িটানা ঘুড়ি! এখন দাম কত জানি না! আমাদের ছোটবেলায় অস্ট্রেলিয়ান কাগজের এমন কড়িটানা দেড়তে ঘুড়ির দাম ছিল বোধ হয় পাঁচ টাকা। সাধারণ কাগজের একতে ঘুড়ি ছিল এক টাকা, আধতে আটানা। বড় দাদাদের কেউ কেউ দোতে ঘুড়ি ওড়াতেন। কী টান! মাঠ থেকে কয়েকজন মিলে মোটা কাছি বেঁধে ইয়াব্বড় এক ঘুড়ি উড়িয়েছিল কয়েকবার! কী তার শব্দ! কী তার টান! বাপরে বাপ! কেউ বলত সেটা নাকি পাঁচতে ঘুড়ি, তো কেউ বলত ঢাউস! কোনটা ঠিক কে জানে! তার তুলনায় এ সব ঘুড়ি নেহাত ‘পতঙ্গ’ই বটে! 


প্যাঁচ খেলতে গিয়ে ঘুড়িটার কলের একটা সুতো কেটেছে। সেটাকে ঠিক করব বলে হাতে তুলে নিতে মনে হলো উলটো দিকে কী যেন লেখা! ঘুরিয়ে দেখি সরু সরু অক্ষরে নাম লেখা – বঙ্কা। তার নিচে দুটো মুঠো বাঁধা হাতের ছবি আঁকা, পাশে আর একটু মোটা হরফে লেখা- “ওরা কাজ করে!”


বিশ্বকর্মা পুজো ছিল আজ। ছুটি। বিকেলে ছাতে পায়চারি করতে এসে হাতে পাওয়া চৌদ্দ আনা সুতোর বাকি দু আনা ঘুড়িটার লেখা বিকেলটাকে যাকে বলে একটু ঝাঁকিয়ে দিল। বিশ্বকর্মা- বিশ্বকর্মণ- দেবশিল্পী, দেবস্থপতি, দেবভাস্কর- বিশ্ব জুড়ে তার স্থাপত্য ভাস্কর্য আর প্রযুক্তির শিল্প। শিল্পী বিশ্বকর্মা। এই জগৎ চরাচরের সব প্রযুক্তির, সব শিল্পের স্থপতি। পুষ্পক বিমানের নির্মাতা; বজ্রপাশ, শতঘ্নী- মারণাস্ত্রের নির্মাণশিল্পী। ‘প্রকৃ্তিরহস্যজ্ঞানং শিল্পবিজ্ঞানদক্ষতাম’! ভাদ্র সংক্রান্তিতে তাঁর আরাধনা। রাত পেরোলেই শরৎ। মানে দুর্গাপুজোর শুরুয়াতি ঘন্টা। বিশ্বকর্মার পুজোয় শিল্পবিজ্ঞানের শ্রীবৃদ্ধি। বন্দনায় আছে- “তিনি দেবতাদের মহতি আশ্রয়, মহা প্রভান্বিত, শিল্পীদের ইন্দ্রস্বরূপ এবং সন্তান সন্ততিদের আশ্রয়স্থল”। মনে পড়ল, নারায়ণ সান্যাল তাঁর বাস্তুবিজ্ঞান গ্রন্থের মুখবন্ধে পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে ব্রহ্মার মানস পুত্র বিশ্বকর্মা রচিত ‘স্থাপত্য বেদ’ এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। বইটার পিডিএফ আছে মোবাইলে। সেটা খুলে দেখলাম পৌরাণিক ভাবনার পাশাপাশি ঐতিহাসিক চেতনার উল্লেখে তিনি লিখেছেন- “পূর্বেই বলিয়াছি, বাস্তুবিদ্যা বিষয়ে আর্যগণের প্রধান চিন্তানায়ক ছিলেন বিশ্বকর্মা। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তিনি গৃহ-নির্মাণ এবং নগর ও গ্রাম পত্তনের নিয়মাবলী ও বিধিনিষেধ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। বিশ্বকর্মা তাঁহার বাস্তু-বিদ্যা বা বাস্তুশাস্ত্রম গ্রন্থে  সর্বপ্রথম গৃহারম্ভের “কাল-পরীক্ষা (Proper time for commencement) করিতে বলিয়াছেন। তৎপরে “দিক নির্ণয় (Orientation) , “দ্রব্য সংগ্রহ ( Collection of building materials), “ভূ-পরীক্ষা (Selection of soil and site), “ভবন-লক্ষণ (Planning of the house) প্রভৃতি পরিচ্ছেদে যেভাবে অগ্রসর হইয়াছেন, তাহাতে বিস্মিত হইতে হয়। মনে হয় না যে, গ্রন্থকার দ্বি-সহস্রাধিক বর্ষেরও পূর্বের একজন বাস্তুকার! মন্দিরের কার্যে বিশ্বকর্মা যে অষ্ট প্রকারের কাষ্ঠ এবং সাধারণ গৃহস্থ-বাড়ীতে যে ত্রয়োবিংশতি পর্যায়ের কাষ্ঠ অনুমোদন করিয়াছেন, তাহার অধিকাংশ আজিও আমরা ব্যবহার করি”।


পৌরাণিক হোক, ঐতিহাসিক হোক- আদত কথা, বিশ্বকর্মার শিল্প স্থাপত্য প্রযুক্তির কাছে নত হওয়ার, বন্দনার দিন আজ। শিল্পীকে, স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন। যদিও সময় বদলেছে, প্রেক্ষিত হয়তো বদলেছে! বদলাবেই না কেন? বিশ্বকর্মার বরপুত্র কন্যাদের সম্মিলিত প্রযুক্তি তে তো ‘পৃথিবী ছোট হতে হতে’ আপাতত মুঠোফোনে বন্দি। কাজেই বিশ্বকর্মা পুজোয় এখন আর দুর্গা পুজোর আভাষ পেতে চাওয়া সুনন্দর জার্নালে পড়া সেই ছোটোগল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়া পাওয়ার মতো- ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ধারে গিয়ে একটি গোলাপের পাঁপড়ি নিচে ফেলে প্রতিধ্বনি শোনার অপেক্ষা’! মেলে না, মেলার কথাও না। ছেলে মেয়েদের মধ্যে ঘুড়ি ওড়ানোর চলও অনেকটাই নিম্নমুখী। তাছাড়া কলকারখানা, বাস স্ট্যান্ড, রিক্সা স্ট্যান্ড, টোটো স্ট্যান্ডেই এখনও বিশ্বকর্মা পুজো অনেকটাই সীমাবদ্ধ। সেই অর্থে এখনও সবার নয়। মূলত যে সব শিল্পী, স্থপতিদের আমরা এক কথায় শ্রমিক বলেই অভিহিত করে দায় সারি- বিশ্বকর্মার সেই সব সন্তানদের আর কী! অবশ্য একটু ভুল হলো! একেবারে বিস্তার হয়নি, তা তো নয়! খানিক ছড়িয়েছে তো বটে! মধ্যবিত্তেরও তো এখন গাড়ি হয়। তাই কলকারখানা ছাড়িয়ে প্রাইভেট কার, বাইক, স্কুটি পুজোর চল হয়েছে ইদানিং ভালোই। সে ভালো! শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা তো প্রশংসনীয় বটেই। কিন্তু সমস্যাও একটা আছে। শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা আপাতদৃষ্টিতে ক্রমবর্ধমান হলেও শিল্পীর প্রতি উদাসীনতাও ক্রমবর্ধমান। যাঁরা ইট গাঁথেন, দেয়াল গাঁথেন, খিলান, ব্রিজ, শহর বানান- যাঁরা ঢালাইশিল্পী, যাঁরা কাঠ শিল্পী, বয়ন শিল্পী, চর্ম শিল্পী, ঝালাই শিল্পী- যাঁরা দেশে বিদেশে তাঁদের শ্রম, ধারণা, শিল্পের বিনিময়ে জীবন ধারণ করে চলেন- তাঁদের প্রতি সামাজিক উদাসীনতার, উপেক্ষার ছবি তো করোনাকালীন সময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে! এখনও তাই! বিশ্বকর্মা পুজো সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে সেই সব শিল্পীদের একদিনের ভজন- ভোজন- পান- আনন্দের পরিসীমায়। একদিন পুজো হবে, তাঁরা একাত্ম হবেন দেবস্থপতির চেতনার সাথে, মনে জাগবে আশ্বাস- দেব শিল্পীর সন্তান তাঁরা, শিল্পের ধারক বাহক তাঁরা, বিশ্বকর্মা তাঁর সন্তানদের আশ্রয়স্থল। কিন্তু তিনি যে দেবতাদেরও মহতি আশ্রয়! আর যুগে যুগে দেবতাদের নব নব রূপ! মহতি স্থপতি নবরূপী দেবগণের জন্যও নিশ্চয়ই বানিয়ে দেন সম্মোহনী কল! তাই সময় আসে, সময় যায়, প্রদীপের কারিগরের ঘরে আলো নিভন্তই থাকে। এমন টা  না হলে সামাজিক দেব দেবীদের চলবেই বা কেমন করে! এমন আধার না থাকলে কোথায় আর তারা তাদের আশ্বাসের ধারা বর্ষাবেন ভোট পুজোর সময় হলেই? আশ্বাসের বৃষ্টি হবে তুমুল, চাপ পড়লে খানিক পুষ্পবৃষ্টির মতো মিহিদানাও ঝরবে। খিদে দেবীর মায়ায় আত্মবিস্মৃত বিশ্বকর্মার সন্তানেরা সব ভুলে হাত পেতে গ্রহণ করবেন সেই অন্ধকারের দান! যুগে যুগে রাজার ঈর্ষা , আশঙ্কা চরিতার্থ করতে হাতের পাঞ্জা কাটা যাবে আশ্চর্য স্থপতির। তবুও খিদে দেবীর মায়ায় আত্মবিস্মৃত বিশ্বকর্মার সন্তানেরা হাত পেতে গ্রহণ করবেন দানা! এই তো নিয়ম। নিয়মের ব্যতিক্রমে প্রাপ্য সম্মানের জন্য কখনও যদি কেউ ঘুরে দাঁড়ান, কখনও যদি মুঠো হয় হাত, মুঠো হাতে ঝলসে ওঠে মাঠের ফসল তোলা কাস্তে, পথ গড়ার কারিগর গাঁইতি, ইট গাঁথার শিল্পী কন্নিক, পাথর ভাঙ্গা ভাস্কর হাতুড়ি- সিংহাসন আর তার আশপাশের সবাই বসবেন মন্ত্রনায়। চুপিচুপি, লুকাছুপি। কে সরকার, কে বিরোধী- কিচ্ছু বোঝা যাবে না! শত্রু, সুহৃদ- সব রকম সাজে সেজে সবাই মিলে মিশে যাবেন তরঙ্গে। তরঙ্গ ভাঙতে সব রকম চেষ্টা চলবে। যতদিন লাগে লাগুক, কুছ পরোয়া নেহি! তরঙ্গ রুখতেই হবে । সুদূর অথবা নিকট ইতিহাস তো তাই দেখায়।


উদোমের নেই বাটপারের ভয়। বঙ্কার নামের পাশে নিজের নামটা লিখলাম। যতটুকু সুতো আছের ওড়াই। তারপর সুতো ছিঁড়ে দেব ঘুড়িটার। শুনেছি, বাবুরা নাকি সে সময় একশো টাকা দুশো টাকার নোট বেঁধে উড়িয়ে দিতেন ঘুড়ি। হুড়োহুড়ি পড়ে যেত নাকি সে সব ঘুড়ি ধরার জন্য! বঙ্কার হাত ঘুরে আজ আমিও উড়িয়ে দেব অক্ষর! হুড়োহুড়ি না পরুক কারও হাতে গিয়ে তো উঠবে!


আরও কতগুলো ঘুড়ি কেটে গেল! চেত্তা খেতে খেতে একটা লাল হলুদ পেটকাটি ভেসে আসছে ছাতের দিকে। অপেক্ষা করছি। আশা ভাসছে চোখে- আকাশ জুড়ে




উড়ে যাচ্ছে ঘুড়ি, ঘুড়ির বুকে ভেসে যাচ্ছে অক্ষর… সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে অমোঘ অক্ষর –


শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে

ওরা কাজ করে

Tuesday, May 16, 2023

যেমন করে গাইছে আকাশ



কাছে এসে বসো।

কথা নয়, পাখিগুলো উড়ে যাবে।
জানালা খুলে দাও।
বৃষ্টির গুঁড়ো আসুক।
তোমায় ভিজতে হবে।
বেশি ভিজলে তোমার তো শ্বাসকষ্ট হয়।
সরে এসো। বৃষ্টির গুঁড়ো আসুক।

দুজনায় মিলে হেঁটে চলে যাই অজানা দূর
বুকের ভিতরে গাইছে একটা অচেনা সুর
তোমার কাছেই সব খুশিগুলো জীবনভর
সব ভুলে গেছি সব ভুলে গেছি আপনপর
সব চাওয়া পাওয়া ছুঁড়েই ফেলেছি
চোখ ভরে শুধু তোমাকে দেখেছি
তোমার কাছেই জীবন দিলাম গচ্ছিত
শালের পাতায় ভাত বেড়ে দাও
কলস থেকে জল ভরে দাও
জীবনখেলায় তোমায় ভুলে লজ্জিত 

কোথাও যাওয়ার নেই।
পাশটিতে এসে বোসো।

আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরছে
ঘাসের উপর
পাতার উপর
রোদের উপর বৃষ্টি নামুক
তোমায় ছুঁয়ে বৃষ্টি নামুক পুনর্বার

এই মুহূর্ত কোথায় ছিল
কীসের লোভে ভুলেছিলাম জীবনপুর
অবসরের মাঠ খোলা থাক
যুদ্ধবিমান আজ তোলা থাক
চোখের উপর ভাসতে থাকুক সমুদ্দুর

কিচ্ছু করার নেই
কোনো কাজ বাকি নেই আমাদের
এসো, পাশাপাশি বসে দেখি শুধু

ঝরছে যেমন ঝরতে থাকুক
পুড়ছে অধর পুড়তে থাকুক
বদর বদর! দাও, তুলে দাও নাওয়ের কাছি
অনেক পরে বৃষ্টি এলো
জ্যোৎস্না ফোটাও আমার আলো
একদিন নয় মানুষ হয়ে এমন বাঁচি

উবুর ঝাপুর বৃষ্টিতে আজ নেশায় আছি



- শাশ্বত কর