Featured Post

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যা...

Monday, November 14, 2022

রসেবশে রসগোল্লা, জালে বসা সমাজ





হুঁ হুঁ বাবা অ্যায়সা ব্যায়সা যুগ নেহি, যাকে বলে আদ্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ! খাওয়া থেকে পেট খোলসা, অজীর্ণ থেকে কোষ্ঠকাঠিন্য সব কিছুই উৎসবের অনুসারী শিল্প। সিনেমা থেটার থেকে আদুরে ছানার দুধের দাঁত পড়া সব ফোটোগ্রাফির সাবজেক্ট! খিচিক খিচিক মোবাইল চমকাও, ঢিচিকসে ওয়ালে পোস্টাও- ব্যস! লাইকস! লাইকস! লাইকস! ঘেঁচু বা কাঁচকলা অথবা ঠেঙ্গা নামক যে নঞর্থক এক্সপ্রেশনটি ছিল, সেই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দর্শনের আশ ইদানীং ভগবান দর্শনের ব্যাকুলতার মত! রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেন, যত মত তত পথ। অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন হাইটেক মনুষ্যকুল! নিত্য নতুন পথের সন্ধানে তারা নিরন্তর ব্যস্ত। যত পথ ততই কিচাং। যত কিচাং ততই তো সুখ। ভুরি ভুরি পোস্ট ঢেউয়ের মত আছাড়ি বিছারি। তক্ক, বিতক্ক, ঠোনা পালটি ঠোনায় পক্ষে বিপক্ষে সমাজ একেবারে উত্তাল!

তা বলে যেন তেঁতুল পাতা ন’জন সমাজ ভেবে বসবেন না! ও সব বেশ পুরনো দিনের কথাবাত্তা! এখন ভার্চুয়াল সমাজের দিন! কাজেই ভার্চুয়ালি সামাজিক সবাই। ভার্চুয়াল বিপ্লব, ভার্চুয়াল নৈবেদ্য, ভার্চুয়াল পরকীয়া, ভার্চুয়াল বিল্বপত্রপুষ্পাঞ্জলি। নিত্যি দিন আপডেটেড থাকতে চান তো বস ভার্চুয়াল বিশ্বে আসুন। লোকাল টু গ্লোবাল যে কোনও বিষয় নিয়ে পোস্টাপুস্টি করুন। পাড়ায় ছেনোদার বাওয়াল থেকে সেলিব্রিটির লুকোনো ছাওয়াল, মাওয়ালি থেকে কাওয়ালি, পোস্ট মডার্ন আর্ট টু নেপোলিয়ন বোনাপার্ট- মতামত দিন, আলোচনার খই ফোটান। অন্যের উন্নতির ফোটোয় ‘শুভেচ্ছা’ লিখে মনের সুখে ‘শ’ কারান্ত অবতারের শাবক বলে গাল পাড়ুন! সুখই সুখ!

মোবাইলে সশব্দ ঢ্যারা দিয়ে রাখুন বিশেষ দিনগুলোয়। ঠিক ঠাক পোস্ট দিলে যেকোনো দিবসের আপনিই ‘দি বস’! দৈনন্দিন খবর টবর রাখুন। কোনও বল মাটিতে পড়তে দেওয়া যাবে না! এভারেস্টে চড়তে গিয়ে কে নিখোঁজ হল, সবার আগে পোস্টান। পারলে পদ্য লিখুন। যে কোনও রিসেন্ট জিনিস পাবলিক ফাটাফাটি খায়। এই দেখুন না এখন কেমন রসগোল্লা খাচ্ছে পাবলিক! যে কোনও মিডিয়ায় যান, রসগোল্লার রসে রসে একেবারে রসাকার! বছর দুয়েক আগেও একবার এমনি হয়েছিল, তখনও পাবলিক মেতেছিল, তবে এখনকার মাতন অবশ্য আরও গাঢ়! হবে না বলুন, একটা আভিজাত্যের লড়াইয়ে এত বড় জিত বলে কথা!

এই ‘টোটাল’ বিশ্বে সংস্কৃতি নামক আভিজাত্যের পেটেন্ট তো আমাদেরই। এ ব্যাপারে গুরু ‘মন মে হ্যায় বিশোয়াস/ পুরা হ্যায় বিশোয়াস! আমরা সর্বদা উত্তম পুরুষ। আমরা আর্টিস্টিক ঘরানার মানুষ। যৌবনে সবাই পদ্য লিখি। টিকিতে গাঁদা ফুল বেঁধে নাস্তিক্যের ভাষণ ঝাড়ি। এক কথায় কায়িক নয়, ‘লাইক’ মেলার শ্রমে আমাদের বড়ই টান; আর যদি মাইক জুটে যায় তাইলে তো ধরে রাখাই দায়! গুপ্ত চুলকুনির মত সুপ্ত প্রতিভা ভসভসিয়ে উথলে ওঠে। তবে আর একটা কথা না বললেই নয়, আমরা ভোজন রসিক। লাইফের ‘টোটাল’ বাসনার ফিফটি ফাইভ পয়েন্ট ফাইভ সেভেন পার্সেন্ট রসনায় কেন্দ্রীভূত।

এ হেন রসনামোদী আমাদের রসালো ঐতিহ্যের বিশ্ব জয়! কম কথা! বাংলায় ‘টক’ করতে ‘টাং’ হয়তো ‘লক’ হয়, তা বলে কি প্রেম দেবে না! ছানা পোনা কেউ বাংলায় কথা বললে স্ট্যাটাসে ঘ্যাটাস লাগে বটে, তা বলে কি পোস্ট দেব না! ছাওয়াল বাংলা মাধ্যমে পড়লে হয়তো মনে ‘নিম্নচাপে’র বেহুলো বাজে, তা বলে কি ‘হুক্কা’ ডাকলে ‘হুয়া’ দেব না! লড়াই আমাদের জন্মগত অধিকার, বাংলা মায়ের জন্যে আমরা সারাদিন অনলাইন থাকতে পারি। আমাদের টপকে অধিকার নিয়ে যাবে, আর আমরা বসে বসে দেখব ‘আমরা কি মার সেই ছেলে?’

আমাদের সার্চ আছে, রিসার্চ আছে, বুদ্ধি আছে, বাঁশ আছে- আমরা খুঁজে পেতে ঠিক তথ্য জোগাড় করে নেব। নেব কী, নিয়েইছি তো! জি.আই. ট্যাগখানা তো এখন আমাদের! জি.আই. ট্যাগটি খাদ্য না চুল গজানোর কটুগন্ধী তেল- ও সব ভাবার দরকার নেই, ও বস্তুটি পেয়ে রসগোল্লার ন্যাজ কতটা ওঁচালো সে ভাবারও দরকার নেই- দরকার কেবল মাতন। দুগ্গাপুজো চলে গেছে, এমন কী রাশ মেলাও গত- এমন খটখটে খরার সময় এমন হাতে গরম রস উৎসবের হুজুগ পেলেও মাতবো না!

আর তাছাড়া রসগোল্লার সাথে কি আমাদের এক দিনের সম্পক্ক! একই বস্তু, তার কত রস! কত মাত্রা! পরীক্ষার আগে তার নামে অযাত্রা, পরীক্ষায় তাকে পেলে বাড়িতে কু সন্তান, আবার যেই না বাড়ির গুচ্চুমনা ফাস্টোকেলাস পেলে, অমনি নচোগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে নছো বিতরণ! একই অঙ্গে কত রূপ! বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। সে জন্যেই না নাদুস নুদুস গোবর গাণুশকে আদর করে রসগোল্লা ডাকি। আজব দেশের খোঁজ করি যেখানে ‘কচুরি আর রসগোল্লা ছেলে ধরে খায়’! আমাদের রুপোলী নায়িকা মোহ বৃদ্ধি হেতু অনায়াসে ‘কলকাত্তার রসগোল্লা’ হন। পুরনো আমাশা সারাতে লোকাল ময়রার গরম রসগোল্লার প্রাইম টাইমের খোঁজ পড়ে। বে বাড়িতে রসগোল্লার কম্পিটিশন লাগে। বে বাড়ির কথায় মনে পড়ল, মেয়ের বাড়িকে বেকায়দায় ফেলতে হুতাশী পেটুক নিয়ে রসগোল্লা গেলানোর রমণীয় ঐতিহ্যও কিন্তু আমাদের। অবশ্য অন্যরাও খুব একটা কম যান না। রসগোল্লা খাওয়া নিয়ে লখনউয়ের কাছের এক গ্রামে বে পন্ড হবার খবর তো এই বছর খানেক আগের! তবে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। রসগোল্লা আমাদের, রসগোল্লার অণু -পরমাণু- ইলেকট্রন- প্রোটন- মেসন- ফ্যাশন - সবেতে আমাদের অধিকার! আর কাউকে ভাগ দেব কি দেব না সে সব আপাতত ভাববো না, হুজুগের ঢেউ উঠেছে যখন ‘জয় মা’ বলে তরী আমরা ভাসাবোই।

হারাধন ময়রা না নবীন চন্দ্র দাস কে ‘রসগোল্লার কলম্বাস’, পাল চৌধুরী না বাগাল- কোন মহাজন রসগোল্লার আদত পৃষ্ঠপোষক সে নিয়ে পদ্য লিখব, গদ্য লিখব, হাঁড়ি ভর্তি করে ছবি তুলব, হাঁড়ি মাটি না পলিমার কীসের হওয়া উচিত সে সব নিয়ে তক্ক জুড়ব- কত স্কোপ! কেউ ছাড়ে! উৎসবের মেজাজ বাড়াতে রস উৎসব করব, মনস্টার গোল্লা বানাব, সেলফি তুলে ক্যাপশন দেব- ‘আমি ও আমার রস’! কত সুযোগ বলুন তো বস!

তারপর এই আমরা, টপ টু বোটম অসাম্প্রদায়িক শিক্ষিত সংস্কৃত সমাজ বিজেতার হাসি ঝুলিয়ে বিজিত প্রতিবেশীদের আদর করে উড়ে বলব, গাল পাড়ব, ভাষা- উচ্চারণ মায় সৎকার নিয়ে খিল্লি করব। এই না হলে চলে!

দাস আর দাসত্ব, প্রভু আর প্রভুত্বের এই সুপ্রাচীন গড্ডলিকা প্রবাহের সমাজে হুজুগের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে যা যা না করলেও চলে তার সব আমরা করব, রসগোল্লার রস নিংড়ে ছিবড়ে না হওয়া পর্যন্ত করব, রসে মুখ মেরে এলেও নোনতা খেয়ে ফের রস খাব, একাই খাব- কিঁউ কি ভার্চুয়াল আমি-র বড় একলা বাঁচার অভ্যেস। কিন্তু হে রসগ্রাহী বঙ্গভূমের ব্যঙ্গপ্রেমী সোশ্যাল মিডিয়ার পথিককুল, ফুটপাথের ফুলো পেটের শিশুটার হাতে একটিও কি রসগোল্লা উঠবে না! 


যদি বা ওঠে, ছবি তুলে পোস্টাব কি ভার্চুয়াল ‘কাঁচকলা’র আশায়?

প্রকাশিত:
19.11.2017
Magazine.kolkata24x7.com 


ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত 

Saturday, October 29, 2022

বল্লভপুরের রূপকথা- সিনেমায় নাটক, না কি নাটকের সিনেমা?

শাশ্বত কর 






রিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য মনে হয় এই প্রশ্নের মুখোমুখি  বারবার হয়েছেন এই ছবি বানানোর সময় অথবা বাদল সরকারের এই মঞ্চ সফল জনপ্রিয় নাটকের ছবি বানাবেন এমনটা স্থির করার সময়। কী নতুন তিনি দেবেন যাতে সিনেমার ক্যানভাসে নাটকের ছবি অক্ষুণ্ণ থাকে! অবশ্যই ভেবেছেন, অনেক ভেবেছেন। আর আমাদের মতো সাধারণ দর্শকরা সেই ছবি দেখার শুরু থেকে শেষ সেই পরিণত ভাবনা চিন্তার প্রতিফলন দেখেছেন। অনবদ্য মুন্সিয়ানায় নাটকের সিনেমায়ন করেছেন অনির্বাণ।

মূল নাটক খুব বেশি বদলাননি অনির্বাণ। তবে শুরুটা বদলেছেন, সিনেমা দেখাতে বদলাতে হতোও। মূল নাটক শুরু হয় মূল চরিত্র রাজাবাহাদুর ভূপতি রায় এর বন্ধু সঞ্জীবের সরস সংলাপে , তিনিই যেন সূত্রধার,  তাঁর কথায় দর্শক নাটকের সিংহদুয়ার পাড় হয়ে ঢুকে পড়ে বল্লভপুর রাজবাড়িতে। আর এই সিনেমার শুরু করেছেন অনির্বাণ মোটামুটি নাটকের মধ্যেই এক ঘটনা থেকে। রাজাবাহাদুর ভূপতি রায় মনোহরকে লুকিয়ে ডিসট্যান্ট সিগন্যালে ট্রেন থেকে নেমে পালিয়ে এসেছেন বলেছিলেন । এই ছোট্ট সংলাপের বড় একটা ছবি এঁকে তা দিয়ে দর্শককে প্রথমেই বেঁধে ফেলেছেন পরিচালক। অন্ধকারে মাঝির সাথে রাজাবাহাদুরের কথোপকথনের এই দৃশ্য তার দৃশ্যগুণে কত যে ডাইমেনশন তৈরি করে! নাটকীয় ধাক্কা দেওয়ার ক্ষমতা আছে অনির্বাণের। নৌকোর সংলাপ থেকে ধপাস করে ফেলে দেন যখন রাজাবাহাদুর বলেন, 'টাকাটা হপ্তা দুয়েক বাদে এসে মনোহরের থেকে নিয়ে যাস। আজ ......খুচরো নেই!'- রাজাবাহাদুরের এটুকু বলেই সামনে হাঁটা আর মাঝির সেই দৃষ্টি- এই থেকেই রাজাবাহাদুর সম্পর্কৃ একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায়। অন্ধকারে রাজার পিছু নেয় তিনটে লোক! তুমুল সাসপেন্স! এই রাজাবাহাদুর আসলে কে? রাজবাড়ির বঞ্চিত কুমার কি? নিশুত রাতে কি লুকিয়ে রাজবাড়ির গুপ্তধন লুঠ করতে এসেছেন? লোক তিন জন কারা? কী চায়? এর পরেই নাটকীয় ধাক্কা! সাসপেন্স ঘন করা লোক তিনটের একজনের কুমড়োগড়াগড়ি! আর তাদের কথা থেকে তাদের সরল সাদা চরিত্রের আবছা প্রকাশ। ওদিকে রাজাবাহাদুর ততক্ষণে আঁধারছাওয়া প্রেতপুরির মতো অট্টালিকায় দড়িদড়া বেয়ে চোরের মতো ঢুকছেন! আশ্চর্য সেই দৃশ্য! এই শান্ত, এই ভয় রসের ঢেউ! রাজঘড়িতে টিক টিক। কাঁটা ছুলো এগারোটা। রাজাবাহাদুর ঘুমের ভানে চোখ বুজলেন।  তারপর শুরু হলো ভৌতিক কারবার! টানটান দর্শক। আবার নাটকীয় ধাক্কা! ভেসে উঠল সুর। গানের আবহ এরপর বাদল সরকারের সাথে এই প্রজন্মের দর্শকের পরিচয় করিয়ে প্রায় তাঁর হাত ধরেই নিয়ে গেল বল্লভপুরের রপকথায়।




আর গপ্প বলব না। আমি তো আর স্পয়লার দিতে বসিনি রে বাবা! ছবিটা দেখে খুবই ভালো লেগেছে বলে নিজের খাতায় লিখে রাখছি কেবল। তবে একটা কথা বলব। এরপর সিনেমা হাঁটবে নাটকের পথে।  প্রবেশ, প্রস্থান, মঞ্চসজ্জা, পোশাক, আবহ, আলো, সংলাপ- সর্বোপরি অভিনয় - সবটাই নাটকের স্বাদ দেবেই। ভালো লাগাবেই। মূল নাটকে সব মিলিয়ে চরিত্র দশ, না কি ভুল হলো! রঘুদাকে ধরে বোধহয় এগারোই হবে! কিন্ত রঘুদাকে ধরব কি? নাট্যকার তো নিজেই বলেছেন, "রায়রায়ান রঘুপতি ভুঁইঞা'কে 'নিয়ে এখনই মাথা ঘামানোর কিছু নেই'! সিনেমায় দু একটা বেশি চরিত্র।  থাকবেই। সংলাপের কথায় মনে এলো, মূল নাটকের সংলাপ কিন্ত খুব বেশি বদলাননি পরিচালক, বলা চলে অক্ষুণ্ণই রেখেছেন। নাটকের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা না থাকলে এ কাজ সম্ভব না। কারণ যতই যা হোক, পরিচালক গড়ছেন তো সিনেমা। সিনেমার তো নিজস্ব কথা আছে। নাটকের থেকে তা তো আলাদা। এদিক ওদিক হলে তো আর দর্শকের ভালো লাগবে না! কাজেই সিনেমাই বানিয়েছেন অনির্বাণ।  তবে মোদ্দা কথা হলো সিনেমা এখানে নাটককে খেয়ে ফেলেনি।  পরিচালক সচেতন ভাবে তা আটকেছেন। একই ভাবে নাটকও এখানে সিনেমাকে গ্রাস করেনি। পরিচালক সচেতন ভাবে সেটিকেও সামলেছেন। এমন মুন্সিয়ানা যাঁর, তিনি তো না থেকেও গোটা ছবি জুড়ে থাকবেনই। অবশ্য অভিনয়ে ছিলেন না বললে বোধ হয় ভুল হবে। রাজাবাহাদুরের ভয়েস বোধ হয় অনির্বাণের। অন্তত ধরণে তেমনই তো লাগছিল।

এই ছবির চরিত্র যারা করেছেন,  প্রত্যেকেই সুবিচার করেছেন চরিত্রের প্রতি। মনোহরের "হেই হপ" অথবা যাকে বলে একেবারে আগমার্কা মোঘলিয়ানা- "বন্দেগী আমীর মেহেমান! গরীবখানায় তসরিফ রাখতে হুকুম হোক! আমি রাজাবাহাদুরকে এত্তেলা দিই!' " রায় রায়ান রাজচক্রবর্তী শ্রীল শ্রীমান রাজা ভূপতি রায় ভুঁইঞা বাহাদু-র!" -জীর্ণ রাজবাড়িতে সত্যিই আভিজাত্যের রোয়াব! সব গিয়েও আভিজাত্যের প্রতি আনুগত্য- পাওনাদার টু সাজনদার কনভার্সন- সব একেবারে প্রাণবন্ত কুশিলবদের অভিনয়ে। এই যে থেকেও নেই রঘুদা- তাঁর কন্ঠে কালীদাস শুনলে যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবেন এখনও। রাজাবাহাদুরের চরিত্রটি যিনি করলেন, সেই সত্যম ভট্টাচার্যও খুব সপ্রতিভ। মন কেড়েছেন। খুব পরিচিত মুখ বলতে আমার কাছে ছন্দার চরিত্রের সুরঙ্গনা। কিন্ত প্রত্যেকেই তাঁদের দক্ষতা দেখিয়েছেন। অভিনয় দেখে মনে হয়েছে তাঁরা সবাই সম্ভবত নাটকের মানুষ। বাদল সরকারের নাটক তো! হাজার মাত্রা! হাজার দিকে গতি অথচ সুস্পষ্ট অভিমুখ। আর হাস্যরস।  ভয় রসের সাথে হাস্যরস, প্রেমরস, বাৎসল্য, সখ্যতা- সবকিছুর অনবদ্য মিশেল। অনেকদিন বাদে বাংলা পর্দায় এমন নাটক আঁকার বলিষ্ঠ সৃজনশীলতা দেখলাম। মনে থেকে যাবে বহুদিন।

এই নাটক বহু প্রযোজিত,  বহু চর্চিত, বহু অভিনীত,  পরিচালিত। 1963-64 তে লিখেছিলেন বাদল সরকার। গল্পের মূল রসিকতাটুকুতে  পুরোনো এক বিদেশী ছবির ছায়া থাকলেও চরিত্র চিত্রণ, নাট্যশৈলী,  সংলাপ- সবই বাদল সরকারের।  প্রথম অভিনয় হিন্দীতে। তারপর মারাঠীতে। তারপর বাংলায়। নাট্যকারের পরিচালনায় 1970 থেকে। তার মানে সেই অর্থে নাটকটাই প্রায় ষাট বছরের। তারপর বহু গোষ্ঠী এই নাটকের মঞ্চায়ন করেছেন। বছর পাঁচেক আগে সম্ভবত অখিলেশ জয়সওয়ালের পরিচালনায় "বল্লভপুর কী রূপকথা' নামে একটা সিনেমাও হয়েছে। তা হলে অনির্বাণের এই নতুন সিনেমা কী আর এমন নতুন?

উত্তর দিয়েছেন পরিচালক নিজেই। সিনেমার শুরুতে একবার,  শেষে একবার। একটা লুপ এঁকেছেন। একটা বৃত্ত। একই সংলাপ,  দু'জনের মুখে। একবার শুরুতে মাঝিকে দিয়ে বলিয়েছেন,  আর একবার শেষে সাহা বলেছেন। " আমার বাবা বলতেন, একই গল্প বারবার বললেও একই থাকে না, বদলে বদলে যায়!"  বদলেছেও। অভিনয়ে না থেকেও গোটা ছবি জুড়ে অনির্বাণ আর তাঁর বাদল সরকার। ছবির শেষে কার্টেন কলের রীতি মেনে একটু খানি যেই না পর্দায় অনির্বাণ এলেন, দর্শকদের হাততালি বুঝিয়ে দিল তাঁর উপস্থিতি!

নাটক আর সিনেমার এই অপূর্ব সহাবস্থান যদি আরও পরিচালকদের উৎসাহিত করেন, তা হলে আরও কত যে ভালো ছবি আমরা পাব! এ পোড়া দেশে নাট্যকার, অভিনেতার যোগ্য সম্মান, সাম্মানিক না থাকলেও ভালো নাটকের তো অভাব নেই।

যা হোক অনেক কথা লিখলাম। কালীপুজোয় শ্বশুরবাড়ি এসে সবাইকে নিয়ে মনের মতো ছবি দেখতে পেলাম। বাড়তি পাওনা, ভায়রাভাই মানসের কল্যাণে শেষে ছবির হালদারমশাই- সন্দীপ ভট্টাচার্যকে বাস্তবে পেয়ে যাওয়া। পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার বাকি দু আনাই বটে। অনেকদিন বাদে বাংলা পর্দায় এমন নাটক আঁকার বলিষ্ঠ সৃজনশীলতা দেখলাম। মনে থেকে যাবে বহুদিন।

দেরি করবেন না, রাজবাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার আগে দেখে আসুন। সপরিবারে।


হালদারমশাই এর সাথে মানস আর আমি। মোহন টকিজ,  বহরমপুর।  26.10.2022 ।


পর্দার হালদারমশাই এর সাথে তাতাই, মন, আমার পুত্ররত্ন বেলো আর মিঠি। মোহন টকিজ, বহরমপুর,  26.10.2022


কার্টেন কল। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য,  সাথে সত্যম ভট্টাচার্য এবং সুরঙ্গনা। সুরঙ্গনার গান সত্যিই অনবদ্য। নন্দন-1, 28.10.2022. ভিডিও সৌজন্য- শ্রীমতী রুবি সরকার। 



দর্শক আবৃত পরিচালক।  নন্দন, 28.10.2022, ছবি সৌজন্য- রুবি সরকার 

Tuesday, February 22, 2022

মেসকুটুম্ব

 



মেস বাড়ি ভারি মজা, কিল চড় নাই- আম জনতার কিন্তু এটাই ধারণা। মেসবাসীরা কেউ কেউ হয় তো হাঁউমাউ করে উঠবেন; হয় তো বলবেন, ‘ বাইরে থেকে ওরম বলাই যায় দাদা, থেকে দেখুন কত ঝক্কি!’ তা সে তো বটেই। ‘সমুদ্র যাত্রায় যে কত যন্ত্রণা, সে কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন’। এ তো ক্লাস ফাইভ থেকে ধ্রুব সত্য। কিন্তু এটাও তো ঠিক, অন্য লোকের সমুদ্রযাত্রার ছবি- দিগন্তের নীলে ডুব দেব দেব নিটোল গোল কমলা লেবু…মেঘ আর জলে তার ছোঁয়া মিশে একাকার…নাম না জানা পাখির পালকে তার রঙ- বলুন, মন টানে না? তবে?

আসলে, মেস হল এমন এক মামাবাড়ি যেখানে ঘাড় ধরে নামিয়ে দেওয়ার কেউ নেই, কানটি ধরে মুলে দেওয়ার কেউ নেই, রাত দুটোয় যেখানে কাপড় কাচতে গেলে কেউ ঝামটা দেয় না, দেরি করে উঠলে মহাভারত থমকে যায় না। পেপার পেতে হাতের মুঠোয় মুড়ি চানাচুর আর কাঁচা লঙ্কার ঝাল যেখানে বিরিয়ানির সোয়াদ দিতে পারে। প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের ঘাম, তিরিক্ষি বসের ঝাল, প্রেমিকার সেন্টু- সব কিছু জাস্ট গপ করে গিলে নিতে পারে- কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আগুন জ্বেলে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ফুঁকে দিতে পারে।

মেস মানে হল আড্ডা। নির্ভেজাল, নিঃস্বার্থ আড্ডা। পড়তে পড়তে আড্ডা, হিসেব মেলাতে মেলাতে আড্ডা, বাজার করতে করতে আড্ডা, লোডশেডিং এ আড্ডা, আলো জ্বললে আড্ডা, খোলা ছাতে আড্ডা, চওড়া সিঁড়িতে আড্ডা। খেতে খেতে, ঘুমোতে ঘুমোতে এমন কি লাগোয়া টয়লেটে বাহ্যকালেও আড্ডা! আড্ডার হরেক রঙ, হরেক বৈচিত্র্য!
কখনও সখনও মাঝবয়েসী মেস মালিকও এসে জোটেন সে আড্ডায়। তাস পড়ে। অ্যাশট্রের নামে এনামেলের বাটি নয়তো ওষুধের বাক্স নামে, চায়ের ধোঁয়ায় আড্ডা জমে ক্ষীর। তখন তিনি আর গৃহস্বামী নন, কুটুমও নন, বরং বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ। মেসের আকাশে মেঘ জমলে তিনি কখনও সখনও আদি রসের ফুলুরি ভাজেন..সমস্বরে কলরোলে তখন গুরু বন্দনা হয়! আবার আষাঢ়ের ঝর ঝর মুখর সন্ধ্যায় চৌকিতে আধশোয়া হয়ে লোডশেডিং এর আবহে হাতের বিড়িতে জম্পেশ টান মেরে যখন শুরু করেন আষাঢ়ে গপ্প- ছমছমে রাতে বিড়ির লাল আগুন জোনাকির মত জ্বলে…পলেস্তারা খসা দেয়ালে মোমের আলোয় শ্রোতাদের ছায়াগুলো কাঁপে!
তবে ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’! মেসও তো আদতে সংসার। ছড়ানো ছেটানো বাসন কোসনে তো ঠোকাঠুকি লাগবেই। শব্দও হবে। সেই তো জীবন। সামান্য বিষয়ে হয়তো তুমুল ঝগড়া লাগবে, নয়তো কিছুই হবে না; কেবল ঝড় ওঠার আগের মত থমথম করবে আকাশ! তারপর অনুনাদী গর্জন শেষে বর্ষণ হলেই খিলখিলিয়ে উঠবে সবুজ।

আর যদি বর্ষণ না হয়, তবেও প্রকৃতির নিয়মেই বৈশাখের বিড়বিড়ানো গরমের ত্রাতা রূপে সন্ধেবেলা ছুটে আসবে হয়তো কোনও ঠাণ্ডা হাওয়া। তৃপ্তির শীতলতা ছুঁয়ে দেবে মন। দল বেঁধে হাওয়ায় এসে বসবে দগ্ধ চাতকেরা। কত কি ঘটে যাবে তারপর, সে সব শোনা কওয়ার আগে ফাঁকতালে এই বেলা বলে রাখি, সেই হাওয়ার মেসওয়ালি নাম গেস্ট আর আদুরে নাম কুটুম।

মেসে গেস্ট এলো মানেই ‘ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে’। তো ননদীর সাথে যতই ঠোকাঠুকি থাক গে যাক, জামাই এলো তো আর দু মুঠো চাল হাঁড়িতে দিতেই হবে, মাসিকে নয়তো ঠাকুরকে বলে মেনুতে দুটো পদ বাড়াতেই হবে, গেস্টকে নিয়ে সব্বাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিতেই হবে। নইলে কুটুম ভাববে কি! মেসের একটা সম্মান আছে না?


কাজেই কুটুম কার সে কথা বড় নয়, এলো যখন,। তখন গোটা মেসের। যার গেস্ট, দেখা যাবে সে হয়তো সারা দিন ধারে কাছেই এলো না, কাজে কম্মে টো টো করল, অথচ তার কুটুম অ্যাটেন করতে রোটেশানে ডিউটি দিয়ে চলল আর সব বোর্ডাররা।

গেস্ট অবশ্য প্রায়শঃ আসেন পরীক্ষা নয়তো ইন্টারভিউ দিতে। কষ্ট করে এসে ওঠাটুকু কেবল, বাকি সব দায় নিয়ে নেবে মেস। কীভাবে যাবে, কোন বাসে উঠবে, কোন স্টপেজে নামবে, সকালে কটায় উঠতে হবে সব কিছু ছকে দেবে। ভাবা যায়!

আবার আর এক রকম গেস্টও আসেন। উদ্বাস্তু। হয়তো ক্লাস শুরু হয়ে গেছে নয়তো চাকরি স্টার্ট, অথচ থাকার ঠাঁই মেলেনি কোথাও! উদ্ভ্রান্ত, বিভ্রান্ত! হয়তো হঠাৎ দেখা মেসের কোনো দাদার সাথে, নয়তো ছোট্ট একটা ফোন। ব্যস! হিল্লে হয়ে গেল। চওড়া বুকে টেনে নেবে মেস। যতদিন না নতুন ঠাঁই খুঁজে দেওয়া যায়, হাসি মুখে ভাগ করে নেবে আড়াই ফুটের বিছানা।

অবশ্য আরও এক ধরণের গেস্টও হন। ‘প্রেম যমুনায় হয় তো কেউ ঢেউ দিল, ঢেউ দিল রে’। আর ঢেউয়ের দোলায় দোল দোল দুলুনি সেই রাঙাবাবু বা, রাঙাদিদি দয়িতের সাথে অ্যাপোর টানে মেসের দরোজায়। ‘ডেটিং করতে বেলা গেল, মা গো মা!’ তো কী আর করার! হাত উঠাও, ফোন ঘুমাও, সিটি বাজাকে বোল- ভাইয়া ফেঁসে গেছি! ব্যস! মেস তোমার ছাতা! এরা মেসে বেশ কমন কুটুম। বেশ খিল্লিও জমে এদের নিয়ে। রস একেবারে টপকে টপকে পড়ে। কথায় বলে, প্রেমের ঘোর এমনই ঘোর যে মহা ঘোড়েল লোকও ক্যাবলা বনে যান। কাজেই প্রেমিকের প্রেম ঘিরে মেসে গপ্প জমে, চাটন জমে। ‘কে প্রথম কাছে এসেছে’, কে প্রথম…মাখো মাখো গপ্পে জমে যায় রাত আড্ডা। প্রেমিকেরও অবশ্য জুটে যায় নতুন বন্ধু, নয়া কাঁধ, যে কাঁধে অনায়াসে নামিয়ে রাখা যায় মাথা।
তবে কপালে যদি জোটে সেই ‘সাড়ে চুয়াত্তর’এর মত আয়েশি কুটুম, ট্যাঁকে যার সুচিত্রা সেনের মত মার কাটারি সুন্দরী- হা গোবিন্দ! ট্র্যাজেডির ফুল ফুটে যায়। ইলিয়াড ওডিসি মহাভারত রামায়ণ সব কিছু ঘটে যেতে পারে! ‘মাসিমা, মালপো খামু’ থেকে শুরু করে মেসের ছাতে ম্যারাপ বেঁধে মালা বদল পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে, সে তো আমরা জানিই! তবে সব কিছুর শেষেও ওই আদি অকৃত্রিম বন্ধুত্ব আর আড্ডা মাথা উঁচু করে ওঠে।

এর নামই তো মেস। এই তো তার গর্বের ঐতিহ্য! এই তো তার যেমন খুশি ছড়ানো ছেটানো ছোট্ট ভুবন। আহা! যদি বাইরের ভুবনটিও এমনই স্বাদে আহ্লাদে ভরা অনাবিল আনন্দের মেস হয়ে ওঠে, সে মেসের মেসিদের সখ্যতায় আর প্রয়োজনীয় ড্রিবলে কত না সুন্দর হয় দিন! ঠিক কি না, বলুন?

12.06.2016 তারিখে কলকাতা24x7.কম এ প্রকাশিত 

নারায়ণ দেবনাথ


 


হঠাৎ বন্ধ আঁকার খাতা, ঝাপসা দৃশ্য যতদূর-

রং শুকোলো, জাল গুটালো রঙিন বেড়াল বাহাদুর!

বাচ্চু বিচ্ছু সুবোধ হলো, ছুটি নিলেন বাঁটুল!
হাঁদাভোদার গাছ মুড়োলো, কাঁদছে শামলা শাটুল!

কেল্টুদা কেন বড্ড শান্ত? নন্টে ফন্টে কান্না?
হাতিরাম পাতি খুলে দিলেন আজ বোর্ডিং এর যত জানলা!
কৌশিক রায় অবসর নিল, অভিযান হলো স্তব্ধ!
শুঁটকি মুটকি বটুকলালেরা রংহীন, নিঃশব্দ!

ডানপিটে খাঁদু বড় হয়ে গেলে কেমিক্যাল দাদু কাজহীন,
ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিতের পাঁচঅঙ্কে আজ ড্রপসিন!
বই জুড়ে সব ভিড় করে আছে নেই শুধু আজ সারথী,
মুখভার আজ শুকতারাদের কাঁদছে কিশোরভারতী!

মনে জমে আছে দুষ্টুমি আর চোখ ভরে আসে কষ্ট
শৈশব থেকে শিশুদিনমণি আজ কি গেলেন অস্ত?

অস্ত যায় কি এমন জ্যোতিরা, ফুরোয় কি কিছু আসলে?
মনের ভিতরে যে বীজ পুঁতেছো, গাছ হবেই ঠিক চাষ হলে।

ছেলেবেলাগুলো সোনা করে দিত রংতুলি আর তাঁর মন
ছোটদের মনে আকাশটা ভরে লিখবেন ছবি নারায়ণ।

-শাশ্বত কর, 18-ই জানুয়ারি, 2022