Featured Post

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যা...

Saturday, March 24, 2018

জগুমামা, টুকলু আর চলমান সমাজ





ই গল্পটা শুনেছিলাম বাবার কাছে। প্রচলিত গল্পই। তবু কথামুখ হিসেবে অবশ্যই খাটে। কাজেই উল্লেখ করে ফেলিঃ

     দুই ভাই। বড় জন শান্ত শিষ্ট। ছোট জন স্বাভাবিক সাম্য রক্ষার্থে যাকে বলে পেল্লায় ন্যাজ বিশিষ্ট। প্রথম জন গুছিয়ে কাজ কম্ম করেন, দ্বিতীয় জন গুছোনো জিনিস এলোমেলো করেন। তবে ভায়ে ভায়ে বেজায় ভাব। তাদের পড়ানোর জন্য এলেন এক গৃহ শিক্ষক। তাঁর চেষ্টার তো কোণো ত্রুটি নেই। তবু শিক্ষা ঠিক আশাপ্রদ হয় না। বড় জন তেমন বুঝতে পারে না। আর ছোটজন তো পড়েই না। তখন শিক্ষক মশাইয়ের মনে হলো- নাঃ! এ ভাবে ভবি ভুলবে না। বরং কায়দা করে শেখাতে হবে। প্রকৃতির মাঝে টেনে নিয়ে কাজের আনন্দে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। দুই ভাইকে নিয়ে শিক্ষক এলেন উঠোনে। উঠোনে ভরন্ত কুল গাছ। শিক্ষক গাছ ঝাঁকালেন। টোপা কুল টপটপিয়ে পড়ল। শিক্ষক বললেন, গুণে গুণে কুল তোলা যাক। বড় ভাই গোণে। ছোটো ভাইও গোণেঃ এক, দুই, তিন...ওই দাদা! মাস্টামশাই আঁক করাচ্ছে রে! কুল খেয়ে আর কাজ নাই! পালা পালা!

চেনা গপ্প। জানা কথা। কিন্তু একটা শিক্ষা আছে। সেটি হলো, ছোটদের কিছু শেখানোর কাজটা মোটেই ছোটখাটো নয়। বরং মারাত্মক কঠিন। যদি বিশ্বাস না হয়, কাছাকাছি যে কোনো কিন্ডারগার্টেন স্কুলে গিয়ে দেখুন। যে কোনো শিক্ষিকার সাথে কথা বলুন- সত্যিটা মালুম হয়ে যাবে। এক এক জন বাচ্চা আসলে এক এক জন জিনিয়াস! মারাত্মক সব ভাবনা! কল্পনা যে কোন দিকে দৌড়োবে কেউ জানে না।

এই জিনিয়াসরাই আরও একটু বড় হবে। হাতে পায়ে হয় তো খানিক শান্ত হবে, কিন্তু উপরের স্থির জল দেখে মোটেই মালুম করা যাবে না ভিতরে কী স্রোত বইছে। এদের শেখানো তো আরও কঠিন কাজ।

অথচ এমন কঠিন কাজ বেশ সহজেই করে গেছেন আমাদের অগ্রজ সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীরা। আমাদের এই সময় তো আরও সরেস। হাতে হাতে গুগল! ভূতের গপ্প বলতে গেলেও এখনকার ক্ষুদেরা বলে, কী গো সেই ক্লাসিক ভূত! সেই একই প্যাটার্ণ! সেই বিশ্বজ্ঞানী ক্ষুদে জেনারেশানকে গপ্পের ধাঁচায় বলতে গেলে যে কতটা স্মার্ট কথক হতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জগুমামা, টুকলু, অনন্ত সরখেল বহু কিশোরের সাথের সাথি। বলা ভালো সব বয়সী কিশোরদের কাছের মানুষ। কাজেই বিজ্ঞানী জগবন্ধু, মানে আমাদের জগুমামা অথবা টুকলুর কথা খুব বেশি বিস্তারে বলবার প্রয়োজন পরে না!

শ্রী চট্টোপাধ্যায় অদ্ভুত মুন্সীয়ানায় রহস্য রোমাঞ্চের পাত্রে কিশোরদের পাঠ দেন। তবে তলিয়ে না দেখলে বুঝবার উপায় নেই। অনন্ত সরখেলের কান্ড কারখানায় হাসতে হাসতে অথবা খুন রহস্যের জট ছাড়াতে ছাড়াতে কখন যে সমাজ সম্পর্কে, ইতিহাস সম্পর্কে, সংস্কৃতি সম্পর্কে, ঐতিহ্য সম্পর্কে এমন কী রবীন্দ্র নাথের গান নিয়েও কিশোর হৃদয়ে তথ্য ইনজেক্ট লেখক সে মালুম হতে হতে গপ্প শেষ। কী অদ্ভুত বুনট! কী টানটান নির্মেদ কাহিনি! প্রত্যেকটা কাহিনি ইউনিক। আর প্রত্যেকটা কাহিনির শেষে পাঠক কিশোর ধারণা পেয়ে যাবেন এয়ার প্লেনে চড়বার ধাপগুলো, সতর্কতার বিষয়গুলো, কাহিনির পটভূমিকার ইতিহাসের সংস্কৃতির।

উদাহরণ দিই। সিপাহীজলার বিষাক্ত রাত। কিশোর ভারতী, শারদীয়া ১৪১৮ তে প্রকাশিত। কী অনায়াস বিন্যাসে ত্রিপুরার সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, সর্বোপরি ইতিহাস বলে দেওয়া। এমন ভাবে বলা, যে আর একটু জানার জন্য মনে আগ্রহ জাগতে বাধ্য। প্রসঙ্গত অধ্যাপক পি.সি.রক্ষিতের কথা মনে পড়ছে। শুনেছিলাম আমাদের ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড.মিহির মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। উনি শুনেছিলেন ওঁর শিক্ষকের কাছ থেকে। ঘটনা হয়েছে কী, প্রফেসর রক্ষিত তাঁর শিক্ষার্থীদের কথা প্রসঙ্গে এক দিন শিক্ষকের ভূমিকা সম্পর্কে বলছিলেন, শিক্ষকের কাজ কী জানো? ধরো, ওই ঘরের কোণে গিয়ে এই যে কোনো একটা শিশির ঢাকনা যদি আমি খুলি, গন্ধ বেরোবে। গন্ধটা পেয়েই তোমাদের জানতে ইচ্ছে করবে, গন্ধটা কীসের? অয়েল অফ উইন্টার গ্রিন, না কি আসিটোন? শিক্ষকের কাজ কেবল ওই কৌতুহলটুকু জাগানো। কৌতুহল হলে তুমি তো আপনিই জেনে নেবে সত্যিটা কী। সেই তো প্রকৃত শিক্ষা তোমার।

শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের জগুমামার গল্প পড়ে আমার তো কৌতুহল জাগে। মনে হয়, যে নতুন বইগুলোর নাম এখানে জানলাম পড়তে হবে। যে ইতিহাসটা খানিক জানলাম সেটা আরও একটু জানতে হবে। যে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো গপ্পে বাজল, সত্যি বলছি, গপ্প শেষ হওয়ার পরেই শুনতে ইচ্ছে জাগে।

শ্রী চট্টোপাধ্যায় তাঁর গল্পে পাঠককে পুতুপুতু করে রাখেন না। বরং তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। অকারণ রঙিন চশমায় মন না ঢেকে জগুমামার সংলাপে, কার্যকলাপে আমার ভারতের তো বটেই, ভারতের বাইরের অশান্ত অবস্থাটাও চিত্রিত হয়। সিপাহী জলার বিষাক্ত রাতে যেমন আলফা জঙ্গীদের কার্যকলাপ, তাদের গতিপ্রকৃত, বাড় বাড়ন্তের কারণ- সব চিত্রিত হয়েছে কিশোরদের মত করে। ছোট হোক বয়সে, তবু মানুষ তো, দেশের মানুষ তো! কাজেই সে কেন জানবে না তার মত করে দেশের সমস্যাগুলো! আসলে তো ‘we are on the same boat brother’! কাজেই কেবল রূপ কাহিনির আড়ালে তাকে রাখব কেন? এই ভাবনা যাঁর গল্পে গল্পে ধ্বনিত হয় তাঁকে কুর্নিশ!

আরেকটা কথা বলতেই হবে। সংলাপ। একেবারে কথ্য মার্জিত ভাষার সংলাপ হচ্ছে জগুমামা-টুকলুর কাহিনিগুলোর সম্পদ। ইঞ্জিন বললেও বোধ করি ভুল হবে না। নিবিড় পাঠে প্রতিটা চরিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠেন চোখের সামনে। কী ভাবে সেই চরিত্র রিয়াক্ট করবে পড়তে পড়তে পাঠকের সে নিয়ে প্রত্যাশা তৈরি হয়ে যায়। একেবারে চলচ্চিত্রের মত গোটা ঘটনাক্রম চোখের সামনে ভাসে পড়বার সময়।

কাজেই এমন কাহিনির ট্রেন চলতেই থাকুক, চলতেই থাকুক-যাত্রী হিসেবে আমার তো অন্তত সেটুকুই প্রার্থনা। জগুমামা, টুকলু, অনন্তবাবু একের পর এক ভেদ করে চলুন রহস্য আর গপ্প পড়তে পড়তে অজান্তেই ঋদ্ধ হই আমরা। নিশ্চিন্তে জগুমামার সমস্ত ভক্ত-ভক্তাদের এটাই মনের কথা।




শাশ্বত কর, শময়িতা, ২৪শে মার্চ, ২০১৮


Wednesday, March 21, 2018

এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি


 

 “Poetic Idealization is not a frivolous embellishment, but a profound penetration in virtue of which we pass from troublous emotion to the serenity of contemplation.”                                                                                                                     - Benedetto Croce

মধুমঙ্গল বিশ্বাসেরআরণ্যক খাঁড়িপড়বার পর সবার আগে ইতালীয় দার্শনিক ক্রোচের এই কথাটাই মনে এল কাজেই সেই দিয়েই শুরু করলাম  যদিও কবিতায় জ্ঞানগম্মি আমার কালবোশেখিতে ওড়া ধুলোর মত, তবুও পাঠক তো! সেই জনতা জনার্দনের একজন হয়ে ভালো লাগা অথবা মন্দ লাগার অভিব্যক্তি তো প্রকাশ করাই যেতে পারে
কবি অত্যন্ত সুপরিচিত পাঠক আদৃত বলা যায় কবিকুল আদৃতও অবশ্য যেহেতু আলোচ্য কবি একটি সুপত্রিকার সম্পাদনায় সুদীর্ঘকাল নিযুক্ত, কাজেই কবিকুল বেষ্টনি থেকে অবশ্য তাঁর প্রতি কাব্য লক্ষ্মীর কৃপা খুঁজতে চাওয়া কেবল অনৈতিক নয়, অবৈজ্ঞানিকও বটে

কী আক্কেল বলুন তো, কবিতার বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়ায় আবার কেমনতরো প্রসঙ্গ! ধান ভানতে শিবের গীত! কীসের মাঝে কী/ না পান্তাভাতে ঘি!

আজ্ঞে তা ঠিক নয় যে ভারিক্কি দর্শন আলোচ্য বইটির আনাচে কানাচে, তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতে গেলেও একটু কবিকে জানবার চেষ্টা করা দরকার বলে বোধ হয় অবিশ্যি সে খোঁজ দেবার অবকাশ এটি নয় সুজন পাঠক নিজ আগ্রহে সে কাজটি সমাধা করবেন এটুকুই বলি, সংগ্রামী হৃদয় ( হে পাঠক, আক্ষরিক অর্থেই সংগ্রামি) প্রতি নিয়ত জীবনের যে মোড়ক উন্মোচনের সাক্ষীঃ বেদনার পাশে পাশে অনন্তের অনবদ্য হাসি, পাড়ের ভাঙন আর চড় জেগে ওঠার যে অমোঘ বিস্ময়, ঝরে পরা পাতার পাশে পাশে উদ্ভিন্ন কিশলয়ের গান- সেই অভিযাত্রার অন্তঃজারিত জ্ঞানের প্রতিফলন এইআরণ্যক খাঁড়ি

বইয়ের প্রকাশকাল ২০১৫ অন্তর্ভুক্ত মানিকগুলির রচনাকাল ২০০৮-০৯ উৎসর্গবাবা-কে, নিরক্ষর হয়েও যাঁর অগাধ শিক্ষানুরাগ-মানুষ হওয়ার সাধনায় যাঁর মন্ত্রগুপ্তি সন্ধানী পাঠক, লক্ষ্য করে দেখুন- মানুষ হওয়ার সাধনা বলছেন হাত পা দাঁত নখ সব নিয়েই তো মানুষ আকার নিয়ে জন্মেছি তবু মানুষ হবার সাধনা! সাধনাই তো বটে সাধন বিনে মানুষ হবে না- এই তো অমোঘ বাণী যুগ যুগান্তের সাধনা- মানুষ আকার পেয়ে মানুষ হবার, আপনাকে চেনার- আত্মজ্ঞানের সাধনা

চল্লিশটি কবিতার এই সংকলনের প্রায় অলিন্দে অলিন্দে সেই সাধনার সন্ধ্যাবাতি, শঙ্খধ্বনি বই আলোচনার নয় নিবিড়পাঠের পাঠান্তে অনুধাবনের, নিদিধ্যাসনের

শুধু যাওয়া আসা/ শুধু স্রোতে ভাসাঃ
   কী বলি, কবিতা পড়তে পড়তে মনে রবীন্দ্রনাথের গানখানা ভাসে উপনিষদের স্তোত্র কানে ভেসে আসেপূর্ণাৎ পূর্ণম উদচ্যতে’- পূর্ণ থেকে পূর্ণ গ্রহণ করেও পূর্ণই অবশিষ্ট থেকে যায় কোনো শেষ নেই নেই কোনো শুরু অবশ্য চর্মচক্ষে যে শেষ বা শুরু, সেও যে আপেক্ষিক পরম নয় চরম নয় কেবলই আপাত এই তো বিজ্ঞান বিজ্ঞানকে অতিক্রম করবে কে? তবে বিজ্ঞানকেও তো চিনতে হয়, ছাই এর আস্তরণের আবডালে কোথায় ছুপে আছে অনন্তের সর্বস্ব আগুন, দিনের আবডালে কোথায় মিলিয়ে আছে স্বপ্রভ নক্ষত্রমালা সে তো খুঁজে নিতে হয় সেই তো সাধনা কবি সে সাধনা করেন একান্তে সাধনা করেন সাধনার জন্যে গিরিরাজ হিমালয় নিষ্প্রয়োজন কবিমাত্রেই জানেন বহুত্বের ভিড়ে একলা হয়ে যেতে মনই তাঁর সাধনক্ষেত্র নয় দরোজা তাঁর বার্তাবাহী দরজা থেকে আসা রসদে কবি অন্তরে বসে পাক করেন জারণ লব্ধ জ্ঞান শব্দের আকারে লেখা হয়ে থাকে কাগজে চিদাকাশে যে অপূর্ব বোধোদয়, তার মায়ালু আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে কবিতার খাতা পাঠকের মনোবীণা যদি সেই কম্পাঙ্কে মেলে তবে অনুরণিত হয় সুর হেসে ওঠেন নাদ ব্রহ্ম
বললাম না, কেবল আপেক্ষিকতা, কেবল যাওয়া আসার স্রোত! পড়ে দেখুনঃ
তবু যে নিভৃতজন, লজ্জারুণ, ঘুলঘুলি দিয়ে মিহি ফিনফিনে
যেন ফড়িংডানার তুচ্ছ কেঁপে ওঠা পৌঁছে দেয়
যেন রিংটোন, যেন ধাতবগাত্রের মিহি নিকেলের ছোঁয়া
এই আছে এই নেই, যেন পদ্মপাতায় জল
আশা      (একতারায় বসন্ত , পৃঃ )
রোমান গাথায় ঈশ্বর জেনাসের দুটি মুখ- এক মুখ প্রসারিত অতীতে, আর এক মুখ তাকিয়ে ভবিষ্যতে এই তো নিয়ম জীবনের, এই তো বেঁচে থাকার সুর আরণ্যক খাড়ির কবি লেখেনঃ
প্রাচীন মদের দিকে চেয়ে থাকি
নতুন পাত্রের দিকে চেয়ে থাকি
নুতুন পাত্রের বুকে হেসে উঠবে সময় যে পাতা ঝরে গেল, উড়ে যেতে যেতে কচি সবুজটির গালে আদরের চুম এঁকে যাবে, যে মেঘের জল ঝরে গেল সাগরের তলে মিশে যেতে যেতে সে নবাঙ্কুর মেঘকে শোনাবে রূপকথার গান- এই তো নিয়ম এর অন্যথা কোথায়?


আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজঃ

আমারই চেতনা সে আমাকে বলে দেয় এই তোমার পথ তো সুন্দর আমি সুন্দর দেখতে দেখতে হাঁটি চেতনা বলে, না না! পথ তোমার নয়, যে অসুন্দর, এখানে কালো ধোঁয়া...বিষ! আমার গলা বুজে আসে, ঘাড় নুয়ে পড়ে চেতনা বলে, দেখো সূর্য উঠেছেন দেখি আলোয় ভরে উঠেছে চরাচর সবুজের গালিচায় ফুলের আভা,পাখির গান মূর্ত হয়ে ওঠে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, “তোদের চৈতন্য হোক”! কবি গান, “মার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী”! চেতনার চৈতন্যে উত্তরণ! বড় কঠিন সাধনা চেতনার নাগাল পাওয়াই কি সহজ? জনায় পায়? যে পায় সে লেখেঃ
প্রথম বর্ষার কাদা মনে হল নবনী নবনী
এই খর পদ, যাকে পা বললে লাগসই
রাধা রাধা হয়ে উঠল
অথবাআঁধার অমেয় হলে/ সকলই বৃন্দাবন
চেতনাই মানুষকে স্বতন্ত্র করে চেতনা মেপে মানুষ সেজে ওঠেন আত্মজ্ঞানএর দর্শন হলে মানুষ সর্বব্যেপে একজনকেই দেখতে পান অনন্ত নিরন্তর শক্তির প্রবাহ তাঁর সামনে জেগে ওঠে কেবলই প্রবাহ সেখানে কোনো বন্ধন নেই যেটুকু বন্ধন বলে বোধ হয়, সে তো আপাত...মায়া প্রবাহ ক্ষেত্রপ্রভাবে কোথাও মানুষ, কোথাও নদী, কোথাও হিমশৈল পর্বত কীসের দুঃখ, কীসের শোক! কেবল চলার আনন্দ! মেঘ কি জল জন্মে ফুরিয়ে যাওয়ার দুঃখে মুহ্যমান হয়? হবেই বা কেন? জল থেকে যে মেঘবালিকার নতুন জনম এই তো চক্র এই চাকাই যে চরাচরের একান্ত আপন বৈশিষ্ট্য জগতের যত ঘটনা তার সব নির্ধারিত আপন আপন চক্রে এমন কীচক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি দুখানি ’- সুখ দুঃখও চাকা মেনে নামে ওঠে, দিন রাত্তির থেকে জন্ম মৃত্যু- সব চাকা মেনেঃ নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে! প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি মধুমঙ্গলের কাব্যভাষাঃ

আমরা তো প্রতিদিন দেখি শুকনো পাতাকে ত্যাগ করে
বৃক্ষ; আর ঝরাপাতা পতনের শোক মনে না মেখে উড়ে চলে,
কেবল মানুষই দিন দিন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে...



আছে জন্ম আছে মৃত্যুঃ

Our birth is about a sleep and a forgetting; the soul that rises with us, our life’s star, Hath had elsewhere its setting, And cometh from after” –William Wordsworth
এ কথাখানা যতবার পড়ি কানে বেজে ওঠে শ্রীমৎ ভগবৎ গীতার সুরঃ “ বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়..” জীর্ণ পোশাকের বদল বৈকি তো কিছু নয়। সত্যিই তো। তবে কিসের লেগে হানাহানি, আকচা আকচি! এটা আমার, ওটা তোমার এর ব্যবধান! কীসের যুদ্ধ? কীসের লড়াই? কীসের বিভেদ? কোনো বৈষম্য তো আদতে নেই, আদিতে নেই। তবে মধ্যে কেন? অন্ত বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেখানেও তো থাকার কথা নয়।
এই স্টেশন থেকে ছেড়ে গেল মেট্রো রেল। ঝলমলে আলো ছেড়ে ঢুকে পড়ল অন্ধকার গুহায়, সুড়ঙ্গে। তবে কি শেষ? কই তা তো নয়। ওই তো আঁধারের শেষে ঝলমল করছে নতুন স্টেশন। কবির ভাবনায় জীবনও তো এ ব্যতিরেকে আর কিছু নয়। নয়া জনম যেন ঘুম ভেঙে ওঠা আরেক জীবনে। মৃত্যুও তো শেষ নয়, সে যেন সংবাহী নালিকা- এক জনম থেকে আরেক জনমে। এ ভাবেই তো যুগ যুগান্ত ধরে ভেবে এসেছেন কবি। কবির সংস্কার প্রবাহিত হয়েছে এক জনু থেকে অন্য জনুতে, যেমনি করে জল বয়ে যায় এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে।
কবি মধুমঙ্গল তাঁর এ বইতে পাতাকে ব্যবহার করেছেন বহুমাত্রায়। কখনও পাতা জীবনের দ্যোতকঃ

‘নির্ঘন্ট না মেনেই যার আসা/ তাকে ঝরাপাতা, বসন্তের অভিক্ষেপ বলা যায়’ অথবা, ‘বিরহ যাপিত হল পাতার পোশাকে’। আবার ‘অসুখ নেমে এল পাতার কুটিরে’ নয়তো, ‘পাতার এ দিনযাপন সমগ্রের প্রতিভাস’।

কবি তো প্রকৃতির প্রিয়তম সন্তান। প্রকৃতির টান কবির কাছে মায়ের নাড়ির। নাগরিক কবিও নিজের অজান্তে চলে যান প্রকৃতির অনুসঙ্গে। যেখানে মায়াময় ঘাস। মায়ামেদুর টিলার কোলে নতুন জনপদ। বিভূতিভূষণ, লবটুলিয়া বইহার। কবির মানসভ্রমণ সেখানে চন্দ্রাতুর রাতেঃ “ সেখানে জ্যোৎস্নার ডানা মিহি মসলিন, সে ডাক উপেক্ষা করি স্পর্ধা কোথায়!” কে উপেক্ষা করবেন? কোনো কবি পেরেছেন সে ডাক উপেক্ষা করতে? ডাক পেলে হাঁটতেই হবে পথে, দুই চোখে ভরতেই হবে মায়াময় নেশা..খাড়ির অসহ্য টানে আরণ্যক হতেই হবে কবিকে।


হরিপদ কেরানির সাথে আকবর বাদশার কোনো তফাত নেইঃ

কিনু গোয়ালার গলি তো কেবল একখানে নয় সর্বত্র বনফুল লিখেছিলেন, গাছের ডাল হাতে বুড়ি আমাদের দেশে অনেক আছে সত্যিই কেবল বাইরের মোড়কটুকু আলাদা সেটুকু অন্তর্চক্ষে উন্মোচন করতে জানলেই দেখা যাবে সমাজে সর্বত্র হরিপদ কেরানি কপালের ঘাম ঝাড়ছেন, বাজার আনছেন, দুধ আনছেন, আপিস যাচ্ছেন, ঝগড়া, খুনসুট্খুসকি, উকু্- সবখানে বিচরণ আর আকবর বাদশাও আছেন পোশাক কেবল ভিন্ন চিনে যদি নিতে পারেন দেখবেন ঠিক বোঝা যাবে রোয়াবের শাহি ঝাঁঝ! কিন্তু এখনও কেন এই বৈষম্য? কেন অসাম্য? প্রকৃতি তো তাঁর দানে কার্পণ্য করেন না, অসাম্য দেখান না তবে অসাম্যের ধারক বাহক এরা কারা? সৃষ্টির এত পরেও এখনও মানুষ কেন পেল না মানব জনম? কবি লেখেন, “ আমি তাকে প্রতিদিন দেখি, চল্লিশ অথবা চারশো বছর/ মানুষের মনে তবু জ্বলেনি তো আলো অথচ সেই কবে পুরাণ, কোরানে সাম্যের সুর বেজে উঠেছে, আত্মজ্ঞানের আশ্রয় টুকু খুঁজে নেবার দীপখানা জ্বেলে রেখেছে..জনায় খোঁজে! আপেক্ষিক জগতের সবকিছু, কেবল যে বহতার ধ্বনিটুকু সার সে কে বোঝায় আর কে বা বোঝে? মধুমঙ্গল লেখেন, “ঝরা দিন আর ঝরা পাতা, আমি তাকে জীবনের সামগীত বলি সামগীতের সেই অনাদি সুরের প্রবাহে লীন হন আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরানি আর তাঁদের কাউকেই আলাদা করা তো যায় না! তবে বাদশারই বা কীসের গুমর আর কেরানিরই বা কীসের আক্ষেপ? যে পারাপারের খেয়া আপন খেয়ালে আলেক সাগরে কেবল আসে যায় ভাসে তার যাত্রী হওয়াটাই তো অমোঘ, সে খেয়ায় চড়াও নিজের খেয়ালে নয় আবার কাজ শেষে ফেরত আসাও নিজের খেয়ালে নয় তাইতো পারানির কড়িটুকুও লাগে না যদি লাগেই না তবে কীসের সঞ্চয়? আর ধুলোবালি সঞ্চয় হল না বলে দুঃখই বা কীসের? প্রসঙ্গত উল্লেখ করিঃনির্জন দাঁড়িয়ে থাকি নদীর এপারে/ দেখি, পারাপার চলে, পারাপার.../ অনন্ত খেয়ায়..” এই পারাপারের সাক্ষী হয়ে থেকে কবি অশ্রু লেখেন সনাতন অশ্রুনিয়তির বার্তাবহ অশ্রুকুসুম কবি দেখেন যুগযুগান্তের ধারাপ্রবাহে ভাসে সোনালি পারানি, কবি সেই স্বপ্রভ আলোকবর্তিকাকে দেখে ভাবেনঃসে কি কোনও ঘন অরণ্যের সাবেক জোনাকি”? তারপরেই কবির অতল থেকে ভেসে ওঠে সাম্যগীতির ইচ্ছাটুকু, যে ইচ্ছেয় মুছে যেতে চায় হরিপদ কেরানির খেদ আর বাদশাহী গুমরের ক্লেদঃদীনজনে আলো দেয়, অন্ধজনে চাপার সৌরভ সীমান্তের বৈষম্য গন্ডী ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে চায় কবির মননেঃতারকাঁটা তছনছ হতে চায়, সীমান্তে/ ভীষণ সুনামি হবে...” তারপরতার গোপন গোপনতমে বিশ্বাস/ রেখেকবি চলে যানবিপ্রতীপ ভাবনার দেশে নিবিড় বিষাদের ধ্যান লব্ধ ভাবনায় লেখেন অশ্রুলিখনঃকিছুই হচ্ছে না আজ, সরলরেখাবরাবর/ আলোর ধেনুরা সব বেঁকে যাচ্ছে অন্য সরোবরে

ওরে বিহান হল জাগোরে ভাইঃ

একদম শুরুতেই স্বীকার করেছি কবিতার আলোচনার আমি কেউ নই তাবড় তাবড় কবি আছেন, পণ্ডিত আছেন, দাড়ি আছে সেখানে হাত বুলিয়ে কর গুণে তাঁরা বলতেই পারেনসাত দু গুণে কত হয়?” না বাপু আমার পক্ষে উত্তর দেওয়া অসম্ভব না জানি ছন্দ, না জানি মাত্রা না জানি লয় তবে জানোটা কী হে? আজ্ঞে দেখতে জানি, দেখে একবার সুন্দর বলে বলতে জানি, সেই সুন্দরের রেশটুকু ভোরের বেলায় ঘাসের ডগের জলে মেশাতে জানি তার মানে মোদ্দা কথাটি হল, ভাইটি আদতে তুমি কাব্যি কবিতার জানো না
নাই জানলাম সে তো অপরাধের নয় ছন্দ ছাড়া যে জগতের একটি পাতাও হিলে না, একটি মাছও নড়ে না, একটি সারসও ওড়ে না- সে তো সত্য সেই সত্যেরই তো সন্ধান করেন সাধক সে সাধক কখনো আপনভোলা বৈজ্ঞানিক তো কখনও আলাভোলা কবি আপাতত সেই সত্যের ছোঁয়াচ কবি মধুমঙ্গলেরআরণ্যক খাঁড়ি পরতে পরতে সেই সত্য আমায় ভাবিয়েছে বেশ কিছু কবিতা পাঠে গজলের খুশবু পেয়েছি মুগ্ধতা নয় চিন্তনের খোরাকের জোগান দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দেওয়ার আগে সম্পূর্ণ বইয়ের পাঠে যে কয়টি দ্বন্দ্ব আমার সামনে উঠে এসেছে সেগুলি একবার বলে ছালা গুটোইঃ

স্মৃতি বনাম বর্তমান, জীবাত্মা বনাম পরমাত্মা, প্রকৃতি বনাম কৃত্রিমতা, ভোগ বনাম ত্যাগ, স্থূল চেতন বনাম সূক্ষ্ম মোক্ষভাব অথবা বোধি, প্রেম বনাম শরীর, ব্যক্তি বনাম ব্যষ্টি-এই দ্বন্দ্বগুলোর উত্থাপন, বিস্তার এবং উত্তরণ কবিতা পাঠে আমায় ভাবিয়েছে কোন কবিতার অনুষঙ্গে কোন দ্বন্দ্ব পেলুম তা বলবার দায় আমার নয়, বরং খোঁজবার দায় মরমী পাঠকের অতএব হে পাঠক পড়ুন বিহানবেলার ঘুম ভাঙানিয়া সুর হয়তো শুনতে পেতেও পারেন


ঋণস্বীকারঃ উপনিষদের সুরগুলি যাঁর অক্ষরে অক্ষরে বাজে সেই প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী রবীন্দ্রনাথের কাছে               চিরঋণী এখানেও তাঁর পংক্তি ব্যবহার করায় ফের ঋণস্বীকার করলাম




শাশ্বত কর, শময়িতা, ২১শে মার্চ,২০১৮