Skip to main content

জীবনের নিরন্তর বিচরণের চালচিত্র বিতান চক্রবর্তীর ‘ল্যান্ডমার্ক

 

জীবনের নিরন্তর বিচরণের চালচিত্র বিতান চক্রবর্তীর ‘ল্যান্ডমার্ক

শাশ্বত কর

 

 




বিতানের গল্পের সাথে পরিচয় অনেকদিনের। ব্যক্তি বিতানের সাথে পরিচয় অবশ্য তারও আগের। সেই স্কুল থেকে। একই স্কুল। একই মাস্টারমশাই। একই নাটকের দল। অনেকটা একই ভাবে মনোভূমি তৈরি করে দিয়েছিলেন গহর স্যার, নির্মলস্যার। সেই সময়ের অসংখ্য স্মৃতিকে এক করে এই ব্যক্তিগত কথাটুকু বলার দরকার এই কারণে যে ব্যক্তি বিতান আর গল্প লিখি    য়ে বিতানের কোনো ফারাক আমি চোখে দেখি না। চারপাশ দেখে যেমন বোঝে, যেমনি অনুভব করে তেমনি বলে। চরিত্র ছাড়া আর কিছু বানানোর দিকে হাঁটে না। সহজ কথা স্পষ্ট করে বলার অদ্ভুত দক্ষতা আছে ওর। আগেও দেখেছি, ‘সাম্প্রতিকতম’ গল্পের বইটাতেও তার ব্যতিক্রম দেখলাম না।

কেবল দেখলাম গল্প বলার মুন্সিয়ানা আরও বেড়ে গেছে। অদ্ভুত মোচড় দিচ্ছে গল্পের নানা জায়গায়। ছোটো ছোটো বাক্যে নির্মেদ স্মার্ট কথন। গল্প বলার সময় নিজের আবেগটাকে বেশ কষে বেঁধে রেখে গল্পটাকেই বলছে। ফলে গল্পই আবেগ উসকে দিচ্ছে পাঠকের। ব্র্যাভো!

সব থেকে ভালো লাগার বিষয়, এ হলো একেবারে পরিচিত পরিবেশের গল্প। সিদ্ধার্থ, মলিদি, সমীরদা, নলিনাক্ষ,অহন, শান্তিবুড়ি, মনসা- আরও সব চরিত্ররা- যারা গল্পগুলোর আনাচে কানাচে, রাস্তায়, বাড়িতে বিচরণ করে গল্প ফুটিয়ে তোলেন, তারা কেউই আমাদের অপরিচিত নন। এদের দেখি আমরা রোজ। কেউ হাঁটেন, কেউ লোকাল ট্রেনে চাপেন, কেউ ট্রেনে ফেরি করেন, আবার কেউ উদ্বায়ী দ্রব্যের মতো অদ্ভুত যাদুতে মুহূর্তে সাতভাঙা সাইকেল থেকে বাইক হয়ে ফ্লাইটের নিত্য সওয়ারি হয়ে যান। কেউ উদ্বাস্তু হয়ে যান ভিটেমাটি থেকে, কেউ পরিজন স্বজন থেকে কেউ বা আদর্শ থেকে।  এদের গল্পও আমরা শুনি। কিন্তু এত সব ‘কাজকম্মের’ মধ্যে কোথায় যেন তারা হারিয়ে যান। ‘ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট ব্যথা, কে রাখে খবর তার!’ বিতানকে ধন্যবাদ! ও কেবল খবর রাখে যে তা নয়, খবরের দলিল তৈরি করে। নীরস দলিল না, মালাকারের মুন্সিয়ানায় ঘাসফুলও মনোরম লকেট হয়ে ওঠে।

একটা নরম অথচ তীব্র ভাষার দখল আছে বিতানের। গল্পের মধ্যে কাব্যময়তা খুঁজে পেয়ে গল্পকে তার জায়গা থেকে সরানোর পক্ষে নই। তা হয়ও নি ওর 'ল্যান্ডমার্কে'। তবু ভাষাই তো অক্ষর থেকে অনুভবটাকে মনে নিয়ে আসে, সেই ভাষার পেলবতার কথাই বলছি। অত্যন্ত তীব্র, চোখা ঘটনাকে আলতো করে ঢেলে দিচ্ছে সাদা পাতায়! ভাবটা এমন যে, পাঠক হে! তুমি এবার ঠেলা সামলাও! ‘ভাবো! ভাবা প্র্যাকটিস করো!’

ছোটগল্পের যেমন গুণ থাকা দরকার, তার যথেষ্টই আছে গল্পগুলোয়। বাহুল্য নেই, যতটা দরকার ততটাই বর্ণন, তাতে পাঠকের চিত্তপটে গপ্পের দৃশ্যপট গড়ে উঠতে কোনো সমস্যা হয় না। দুধের ক্যান,  পরোটা, ডাস্টবিন, উচ্ছিষ্টের ভাগবাঁটোয়ারা, তেলচিটে গামছা, চশমা, মানিব্যাগ- টুকরো টুকরো ছবি গল্পগুলো সাজিয়ে তোলে। নাটকের ছেলে বলেই কি না জানিনা, দেখার চোখ আছে, মঞ্চ সাজানোর দক্ষতা আছে। গল্প যেখানে গড়ে উঠছে, স্খানে পৌঁছে যেতে পাঠকের তাই সমস্যা হয় না একেবারে।

এই প্রত্যেক কথার সপক্ষে গল্পগুলো থেকে উদাহরণ তুলে তুলে দিতে পারতাম। কিন্তু সে কাজ আমার পছন্দের নয়! ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির অধ্যাপক বলতেন ‘আগ্রহ তৈরি করাটাই আসল কাজ, বলে দেওয়া নয়! সুগন্ধির ঢাকনা এমন ভাবে খুলে দাও যাতে মন আপনিই সেই সুগন্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়!’ বিতানের নতুন গল্পের বইটার প্রতিটা গল্পের পাঠ শুরু করলে তেমন একটা আগ্রহ জাগে, গল্পের শেষ অবধি টেনে নিয়ে যায়। কখনও কখনও শেষের মোচড়টার রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ। যার জন্য একবারে একটা করে গল্পই আমি পড়তে পেরেছি বইটা থেকে।

রোজকার ঘটে যাওয়া ঘটনার আধারে গড়ে ওঠা বিতানের নতুন বই এর পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে গিয়ে মৌসুমী ভৌমিকের মন কেমন করা গানের সুর ভেসে উঠল মনে। ‘শরীরটারই ভিতরে পরাণ নামের কী যেন কে থাকে, তারই ডাকে আমি ঘর বাহির করি!’ ঘর, বাইরের জীবনের নিরন্তর বিচরণের চালচিত্র গড়ে উঠেছে বিতানের ল্যান্ডমার্কে। প্রকাশককেও ধন্যবাদ মনোজ্ঞ পরিবেশনের জন্য। প্রচ্ছদ থেকে নির্ভুল পরিবেশন- গোটা প্রোডাকশনটাই খুব উচ্চমানের। পাঠকের ভালো লাগবে বলেই আশা রাখি।

 

ল্যান্ডমার্ক, বিতান চক্রবর্তী, শাম্ভবী, হার্ডবাউন্ড, মূল্যঃ ২০০ টাকা

 

Comments

Popular posts from this blog

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যাচ্ছেন কি? যাচ্ছেন কোথায়? লাখ টাকার প্রশ্ন! বিজ্ঞানের এক উত্তর, শিশু ভোলানাথের এক উত্তর, গোঁয়ার গোবিন্দর এক উত্তর, বোদ্ধার এক উত্তর! ঘন রহস্য! অথবা কোনোই রহস্য নেই। কৃষ্ণ কেমন, না যার মন যেমন। জলে হাওয়ায় গেলাস ভরা ভাবলে ভরা, আধখানা খালি ভাবলে খালি। আসল কথাটা হলো আজ বছরের শেষ সন্ধ্যে। আজ হেব্বি সেলিব্রেশন! কোথাও জামাল কুদু, কোথাও লুটপুট গয়া তো   কোথাও দিন হ্যায় সানি সানি সানি-   চারপাশ থেকে নানা রকমের গান ভেসে আসছে। একের সুরে আরেক চেপে বসায় কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না মনে। এমনটাও ভালো। এতেও এক ধরণের নির্লিপ্তি আসে। নির্লিপ্তিই তো মুখ্য, নির্লিপ্তিই মোক্ষ। আজ ভর দুপুরে ছাদে গিয়ে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছপালাগুলোর একটু পরিচর্যা করলাম। খালি দুটো টবে দুটো বীজ পুঁতলাম। একটা উচ্ছের  আর একটা ঢেঁড়সের । এই দুটোই আসলে আজকের বর্ষ শেষের আমি। কাজের দুনিয়ায় যেমন তেঁতো, ঘরের দুনিয়ায় তেমনি ঢেঁড়স। তো দুই আমিকে বছর শেষে দিলাম পুঁতে। নতুন ভোরে খোলস ছেড়ে বেরি

অসুস্থ সমাজ, অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং নিছক সাধারণী আবেদন

  ডাক্তারদের অনশন আজ ১০ দিনে পড়ল । পাঁচই অক্টোবর থেকে আমরণ অনশনে বসেছেন। প্রথমে ছ'জন পরে আরো একজন , উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে আরও দু'জন জুনিয়র ডাক্তার আমরণ অনশনে বসেছেন। বলছি বটে জুনিয়র, কিন্তু যে পর্যায়ের পরিণত মনোভাব এঁরা দেখিয়েছেন এবং দেখাচ্ছেন চিকিৎসা পরিভাষায় যাই হোক, মানবতার পরিভাষায় এরা সিনিয়রস্য সিনিয়র।  অনশন। কেবল জল। আর কিছু নয় । বলাই সহজ, কাজে মোটেই সহজ নয়। একবার রাগ করে না খেয়ে একবেলা ছিলাম। আর মনে পড়ে আর একবার মায়ের সাথে উপোস করেছিলাম কোজাগরি পূর্ণিমায়। দুবারই সন্ধ্যে হতে না হতেই হাটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগেছিল। আর টানা 10 দিন অভুক্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা! এখনো চলছে তাঁদের অনশন ব্রত।  শারীরিক সমস্যা জয় করতে হচ্ছে। জনমানসের আশা প্রত্যাশার পাহাড় জয় করতে হচ্ছে। মানসিক চাপ জয় করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের চাপ। সহজ কথা তো নয়। তাও জয় করতে হচ্ছে। অকথা কুকথাকে খড়কুটোর মত ছুঁড়ে ফেলে পাখির চোখে চোখ রাখতে হচ্ছে। কেন করছেন তারা অনশন? রাজ্যে গত নয়-ই অগস্ট নারকীয় ঘটনা ঘটে গেছে আর জি কর মেডিকেল কলেজে। তাদেরই সহকর্মী দিদি অথবা বোনের নৃশংস পরিণতি তাঁদের মুঠো শক্ত করেছে। চ

এসো মা, এসো মা উমা

 শাশ্বত কর সুপ্তপর্ব “যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে! গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!” ঠাকুর দালানে ধুনুচি সাজানো হচ্ছে। এও এক শিল্প! নারকেলের ছোবড়া উল্টো করে এমন করে সাজা হবে যে ধুনুচি নিম্নমুখী হলেও সহজে পড়বে না! নইলে আরতি জমবে কেমন করে!  ছোবড়া চুঁইয়ে ধোঁয়া মিশছে বাতাসে। বাতাসে ধুনোর গন্ধ! বাতাসে কর্পুরের গন্ধ! বাতাসে শিউলি, ছাতিম, বাতাবি ফুলের গন্ধ! বাতাসে ঠান্ডা আদর! আদর আমার গালে। মায়া আদর, আচ্ছন্ন আদর। যে সুগন্ধী বাতাস নাকি গোলাপের মৃদু পাঁপড়ি এই আদর এঁকে গেল, এই তো খানিক আগে যখন তেতলার চক বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচে ঠাকুরদালানের পাশে রাঙাপিসিমাদের আড্ডা দেখছিলাম, তার নাম এখানে লেখার কীই বা দরকার? গতকাল সকালে পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা সেই আমায় দিয়েছে, ভিড়ের অছিলায় আঙুল ছুঁয়ে গেছে। কাছে আসলেই মায়ের পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা আমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক পুব বাগানের বাঁধানো বেদির পাশে রাত আলো করে থাকা নিশিপদ্মের মতো! এ গন্ধের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা! এখন যেমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি চক বারান্দায়। হাতে শ্রীশঙ্খ! ঠাকুর তোরঙ্গ থেকে বড় শাঁখখানা আনতে পাঠিয়েছিলেন র