Skip to main content

'তুমি তার সেবা কর সুখে'

‘তুমি তার সেবা করো সুখে’
শাশ্বত কর




লিটি ফুটলেই শিশু। বুলি ফুটল তো- মা। এই তো প্রথম নাদ। বিশ্বাস নির্ভরতা আশ্রয়ের শব্দ। মা এবার ডানা ছড়িয়ে আড়াল করবেন শিশুকে। দুনিয়ার ঝড় ঝাপট বৃষ্টির ছাঁট একটুও যাতে না লাগে!


এই তো সেই মমতায় বড় হচ্ছে শিশু। আগামী পৃথিবীর কর্ণধার। টলোমলো পা, আধোআধো বোল। বোলে মায়ের স্বতঃস্ফূর্ত ছোঁয়াচ। মা গেলাস ভরা জল দেখিয়ে বলছেন, ‘ বলো সোনা, জ-অ-ল’, দূর আকাশে চাঁদ দেখিয়ে বলছেন, ‘ বলো সোনা, চাঁদ মা-আ-মা-আ’। শিশু বলছে, ‘ দ-অ-ল...চা-ম্মা-ম্মা...’। আহা! ‘সমুদয় দেববাণী প্রায়’! গোলপানা মুখটি চুমোয় ভরিয়ে এইবার কোলে টেনে নিচ্ছেন মা। কপালে স্নেহের ছোঁয়াচ এঁকে বলছেন, ‘ আয় আয় চাঁদমামা টি’ দিয়ে যা’।
এমনটি যে কেবল তোমার আমার দেশে, তা কিন্তু নয়। সারা জগতের। সব মায়ের। মায়ের স্নেহের মিশেলে ফোটা সেই বুলিই তো মাতৃভাষা। কথা বলার ভাষা, পদ্য লেখার ভাষা, গান গাওয়ার ভাষা, আনন্দ দুঃখ হাসি কান্নার ভাষা। ভূগোল বদলালে সে ভাষার ধাঁচ বদলায়, তবে অন্তঃকরণের প্রবাহটি কিন্তু সেই একই মুখে বয়। সোনা আমার মনের কথা গুছিয়ে বলুক, এই তো মায়ের চাওয়া। তাই তো মাতৃভাষার প্রয়োগ। মায়ের ঋণ যেমন শোধ দেবার নয়, তেমনই মাতৃভাষারও। সবসময় আদরে বরণ করতে হয়। সবার আগে স্থান দিতে হয়। আমার মা যেমন জগত সেরা, আমার মাতৃভাষাও তেমনি সবচেয়ে কোমল, সবচে’ স্নিগ্ধ।


তা বলে কি অন্য ভাষা শিখবোনা? তা আবার হয় নাকি! এ তো উদিত সূর্যের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ানো! কোনো মা-ই তা চাননা। মা যে আকাশ। পূর্ণতার আধার। তিনি কেমন করে চাইবেন যে তার চাঁদের কণা কুয়োর বেড়টিকেই আকাশ বলে চিনুক! কক্ষণো না। মা জানেন, শিশু তার বড় হবে, দশের কাজ করবে, মানুষের মত মানুষ হবে। জন্মক্ষেত্র হয়তো নাও হতে পারে কর্মক্ষেত্র। কাজেই এমন সুবিশাল ধরিত্রী মায়ের কোলে দেয়ার আগে তিনি তো তার সন্তানকে তৈরি করবেনই। কিন্তু অন্য ভাষা শেখার মানে যে মাতৃভাষাটিকে দুয়োরানি করে রাখা নয় সেও তো তিনিই বোঝাবেন। ফট ফট টর টর ভিন ভাষার উচ্চারণে উত্তুঙ্গ প্রশান্তির পাশাপাশি মাতৃভাষার যে অসীম ভাঁড়ার ইতিউতি লুকিয়ে, সে ও তো শিশুকে চিনিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। মাতৃভাষায় কতনা প্রচলিত ছড়া, কতনা লোককথা- বীরগাথা- রাক্ষস- খোক্কস- জিয়ন কাঠি- মরণ কাঠি- হিরামন পাখি-চরকা কাটা বুড়ির এলানো মমতার উঠোন। কোনো অংশে কম নয় ভিন ভাষা থেকে। সে সমৃদ্ধ মায়াময় রূপটিও তো তাকে দেখানো দরকার।


আন ভাষার শিক্ষা হয়তো আমাদের প্রয়োজনের, কিন্তু মাতৃভাষার উচ্চারণ! সে তো স্বতঃস্ফূর্ত। তাই সুললিত। জন্মলগ্নেই যে উচ্চারণের বীজ মস্তিষ্কের ধূসর বস্তুতে প্রোথিত, তাকে পাশে ঠেলে রাখবার কোনো উপায় নেই। তিনি এমনিই সর্বোচ্চ আসনে। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সি। মাতৃভাষাও তাই। স্বীকার করো, চাই না করো- এ তোমার জন্মদাগ। আমৃত্যু সহচর।
যে ভাষা জন্ম থেকে সাথের সাথি, তাতে শিক্ষাগ্রহণও তো তুলনায় সহজ। ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে’ তার অনায়াস প্রবেশ। সুগভীর ছাপ। চাপও তাই ব্যস্ত অনুপাতে কম। অফুরান শব্দভাণ্ডার। বাড়িতে- খেলার মাঠে- গল্পে গানে সর্বত্র শব্দের ঘর। স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষাঙ্গন। কাজেই ভাবনা প্রকাশ অনেকই সহজ। নইলে কিনা মাতৃভাষায় ভাবনা আর দরকারী ভাষায় তর্জমা! পাহাড়ি ফুলের গাছ এনে কচ্ছের রণে চাষ! ফুল যদিবা ফোটে, রূপ-রং-রস-গন্ধ ঠিক তেমনটি আর হয় কি?


আদত কথায় এবার আসা যাক। চুম্বক কথাটি হল শ্রদ্ধা। দুপেয়ে জীবকে মানুষ করার একমাত্র পথ। উপনিষৎ বলেন শ্রদ্ধা অনায়াস। সহজের আবেশে আলোর মত সে ফুটে ওঠে। শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম। জগৎময় বিস্তৃত যে শক্তি সমুদ্র, সেখানে ভাসন নিমজ্জনের একমাত্র ভরসার ডিঙাটিই শ্রদ্ধা। সম্যক জগৎ দর্শনের প্রয়োজনে যে কোন ভাষারই ছন্দোময় হাতখানি ধরা যেতেই পারে, তবে অবশ্যই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। কেন নয়? সে ও তো আমার কোনো বিশ্বভাইয়ের মায়ের ভাষা। তাই যদি করতে পারি তবে আর আলাদা করে মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ার মত লজ্জাস্কর কথাটি বুঝিয়ে বলতে হয়না। মায়ের দায় আপনা আপনিই সন্তান বুঝতে পারে, যদি দৃষ্টি ফোটে। শ্রদ্ধাশীল সেই ফুলন্ত গাছ অচিরেই ফলন্ত হয়। ফলবান সে বৃক্ষের ডাল তো আপনিই তখন নুয়ে আসে মাটি মায়ের কাছাকাছি।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

অসুস্থ সমাজ, অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং নিছক সাধারণী আবেদন

  ডাক্তারদের অনশন আজ ১০ দিনে পড়ল । পাঁচই অক্টোবর থেকে আমরণ অনশনে বসেছেন। প্রথমে ছ'জন পরে আরো একজন , উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে আরও দু'জন জুনিয়র ডাক্তার আমরণ অনশনে বসেছেন। বলছি বটে জুনিয়র, কিন্তু যে পর্যায়ের পরিণত মনোভাব এঁরা দেখিয়েছেন এবং দেখাচ্ছেন চিকিৎসা পরিভাষায় যাই হোক, মানবতার পরিভাষায় এরা সিনিয়রস্য সিনিয়র।  অনশন। কেবল জল। আর কিছু নয় । বলাই সহজ, কাজে মোটেই সহজ নয়। একবার রাগ করে না খেয়ে একবেলা ছিলাম। আর মনে পড়ে আর একবার মায়ের সাথে উপোস করেছিলাম কোজাগরি পূর্ণিমায়। দুবারই সন্ধ্যে হতে না হতেই হাটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগেছিল। আর টানা 10 দিন অভুক্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা! এখনো চলছে তাঁদের অনশন ব্রত।  শারীরিক সমস্যা জয় করতে হচ্ছে। জনমানসের আশা প্রত্যাশার পাহাড় জয় করতে হচ্ছে। মানসিক চাপ জয় করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের চাপ। সহজ কথা তো নয়। তাও জয় করতে হচ্ছে। অকথা কুকথাকে খড়কুটোর মত ছুঁড়ে ফেলে পাখির চোখে চোখ রাখতে হচ্ছে। কেন করছেন তারা অনশন? রাজ্যে গত নয়-ই অগস্ট নারকীয় ঘটনা ঘটে গেছে আর জি কর মেডিকেল কলেজে। তাদেরই সহকর্মী দিদি অথবা বোনের নৃশংস পরিণতি তাঁদের মুঠো শক্ত কর...

এসো মা, এসো মা উমা

 শাশ্বত কর সুপ্তপর্ব “যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে! গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!” ঠাকুর দালানে ধুনুচি সাজানো হচ্ছে। এও এক শিল্প! নারকেলের ছোবড়া উল্টো করে এমন করে সাজা হবে যে ধুনুচি নিম্নমুখী হলেও সহজে পড়বে না! নইলে আরতি জমবে কেমন করে!  ছোবড়া চুঁইয়ে ধোঁয়া মিশছে বাতাসে। বাতাসে ধুনোর গন্ধ! বাতাসে কর্পুরের গন্ধ! বাতাসে শিউলি, ছাতিম, বাতাবি ফুলের গন্ধ! বাতাসে ঠান্ডা আদর! আদর আমার গালে। মায়া আদর, আচ্ছন্ন আদর। যে সুগন্ধী বাতাস নাকি গোলাপের মৃদু পাঁপড়ি এই আদর এঁকে গেল, এই তো খানিক আগে যখন তেতলার চক বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচে ঠাকুরদালানের পাশে রাঙাপিসিমাদের আড্ডা দেখছিলাম, তার নাম এখানে লেখার কীই বা দরকার? গতকাল সকালে পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা সেই আমায় দিয়েছে, ভিড়ের অছিলায় আঙুল ছুঁয়ে গেছে। কাছে আসলেই মায়ের পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা আমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক পুব বাগানের বাঁধানো বেদির পাশে রাত আলো করে থাকা নিশিপদ্মের মতো! এ গন্ধের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা! এখন যেমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি চক বারান্দায়। হাতে শ্রীশঙ্খ! ঠাকুর তোরঙ্গ থেকে বড় শাঁখখানা আনতে পাঠি...