শাশ্বত কর
গরম কোন পর্যায়ে সে তো আর বলা না বলার ধার ধরে না। ঘামে ঘামে বাসে ট্রামে সবাই টের পাচ্ছে।
একটা কাজে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ করে ঘণ্টা চারেকের অবসর পেয়ে গেলাম। অবসর বটে কিন্তু চাআআর ঘণ্টা এই তুমুল রোদে করি কী? সময় বদলেছে। এমন প্রখর দাবদাহে পথিক কি খুঁজতেন? খানিক গাছের ছায়া, তৃষ্ণার জল- এই তো!
আমার কাঁধের ব্যাগে জল, নাকের ডগায় মাস্ক, মাথায় কপালে রোদ্দুরের তেজে গলন্ত স্বেদ। মাথা চিড়বিড় করছে, পেতে ছুঁচো না হোক কেউ তো ডন দিচ্ছে। এই তুমুল আলোয় সত্যি সত্যি চোখে ঝিলমিল লেগে যাচেছ। সামনে অজস্র খাবারের দোকান, চায়ের দোকান। সেসব ছেড়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসে খোলা মাঠ দেখে সময় কাটাব ভাবছিলাম। চোখে মুখে রোদেল হাওয়ার কঠিন চুম্বনএর ঠেলায় সইলো না! বেরিয়ে এলাম।
দক্ষিণ কলকাতার ফুটপাথ। গাছের ছায়ার অভাব নেই, অভাব নেই রোদের দীর্ঘশ্বাসেরও! খানিক উদভ্রান্ত পায়চারির মধ্যেই মরূদ্যানের মত একটা সিনেমা হল। আর পায় কে? টিকেট উইন্ডোতে টিকিটের দাম দেখে খানিক আশ্বস্ত হলাম। এখনো ১১২ টাকায় সিনেমা দেখা যেতে পারে !এই দুপুর রোদে ১১২ টাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসার আরাম। এই ভয়ঙ্কর আশ্রয়হীন সময় এর চাহিদা অনেকটা মায়ের কোলের মতনই। যথারীতি টিকিট কেটে ঢুকে পরলাম।
যথাসময়ে ছবি শুরু হল। আর তারপর থেকে প্রায় দু'ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট নির্বাক হয়ে কী এক জাদুতে মজে রইলাম। বিরাট ঘটনার ঘনঘটা, ধুম ধারাক্কা মারপিট অথবা হিরো ভিলেনের দ্বন্দ্ব অথবা দুষ্টুমিষ্টি নাচানাচি , নিদেন পক্ষে এলিয়েন টেলিয়েন - মানে যা যা থাকা উচিত ছবিটবিতে- তার কিছুই পাইনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন এই ছবিটা আমার আশায় জল ঢেলে দিয়েছে। আশা নিয়ে ঢুকেছিলাম হলের ঠান্ডায় দুদুম দুদুম শব্দের ঘুম পারানিয়ায় বেশ খানিকটা দিবানিদ্রা দেবো। ধুস! তা আর হলো কোথায়?
ছবিটা শুরুতেই এক ঝটকায় টেনে নিয়ে গেলো আমাদের সদ্যোদ্ভিন্ন কৈশোরের ভালোলাগা, ভালোবাসা শেখানোর ছবির মানুষটার কাছে। দৃশ্যপট, সাজসজ্জা, ছবি ধরার কায়দা, গল্প বলার ধরণ- সিনেমার আরো যা কিছু আমার মতো পাতি দর্শকদের মনে থেকে যেতে পারে- তার সব কিছু বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল সিনেমার জাদুকর ঋতুপর্ণ ঘোষকে। আর ঘুম আসে বলুন?
সেই বনেদি বাড়ি, সেই দুর্গাপুজো, সেই বাড়ির মানুষদের মন, মনের ভিতর, সেই সুর, সেই প্রকৃতি। শহর কলকাতার বুকে অমন ঝড়ের দৃশ্য কতদিন কোনো ছবিতে দেখিনি। অবশ্য কটা ছবিই বা দেখি? কিন্তু ছবিতে যে ঝড় ঘনিয়ে উঠবে আর খানিক পরেই, শরতের আকাশে ঝড় তুলে কী মুনশিয়ানায় পরিচালক মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন দুই মুখ্যকে - ভাবা যায় না। অবশ্য এরকম মুনশিয়ানার ছোঁয়াচ গোটা ছবি জুড়েই। পাতি দর্শক সে সব কি আর ব্যাখ্যা করতে পারি?
বলতে না পারা কথা কত কী ঘটিয়ে দিতে পারে! কত ঘটন অঘটন ঘটে যায় সময় মতো কথাটুকু বলতে না পারায় - জীবনে আমরা সবাই জানি। কিন্তু বলতে পারি না কেন? আচ্ছা কী বলতে পারি না বলুন তো? কে আটকায় বলতে? ট্যাবু, সোশ্যাল ট্যাবু। বলতে আটকায়, শুনতে আটকায়, শুনলেও বুঝতে আটকায়, বুঝলেও মানতে আটকায়। আর এতসব আটকাবে ভেবে কথাগুলো নীরবতার সরণি বেয়ে কোনদিন কুয়াশায় অথবা বৃষ্টিতে হারিয়ে যায়। তাতে কার যায় আসে? কারো কারো যায় আসে তো বটেই। তাই তো এমন ছবি বানান কেউ কেউ।
বৃষ্টির কথা বলতে মনে পড়ল- বৃষ্টি, শাওন , মেঘ এর এক অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে ছবিটায়, জানেন?
গপ্প, কাহিনি, স্পয়লার কিচ্ছু বলবো না। ছবিটা সবে বেরিয়েছে। শুধু বলবো সম্ভবত উত্তর কলকাতার এক বনেদি বাড়ি, দুর্গাপুজো , বনেদি বাড়ির হোম স্টে হয়ে ওঠা, হোম স্টের প্রথম গেস্ট, বাড়ির মালিক, মালকিন, ছেলে , বোনপো, পরিচারক সবাইকে নিয়ে গড়ে ওঠা বড় পরিবারের মধ্যে ঘনায়মান নানান মেঘ বৃষ্টির রূপকথায় ভেজা এই ছবিটা । আকাশ , ঘুড়ি, বই, সুর, বৃষ্টি, কলকাতা- কবিতার পেলবতায় সিক্ত এই ছবিটা। শুধু বলবো দেখে আসুন।
ভালোবাসা কীভাবে বেঁচে থাকে দেখে আসুন, ভালোবাসা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখে দেখে আসুন, ভালোবাসা কীভাবে ম্যাজিক তৈরি করে দেখি আসুন, ভালোবাসা কীভাবে ফিরিয়ে আনে দেখে আসুন। সঙ্গে ফ্রী পাবেন অনবদ্য সঙ্গীত, অনবদ্য সব মুহূর্ত, অসামান্য কিছু সংলাপ, অননুকরণীয় কিছু দৃশ্যপট - আর অন্য অনুভূতি জাগানো একটা গল্প। সে অনুভূতিকে যে কী বলি - আনন্দ, দুঃখ, বাৎসল্য, বিরহ, প্রেম, একাকিত্ব, বিষাদ সব যেন সঠিক অনুপানে মিশে আছে।
আচ্ছা আর কি বলা হলো না বলুন তো!
বলা হলো না অভিনয়ের কথা।
বলি কি করে বলুন তো? আমার তো মনে হয়নি একবারও কেউ অভিনয় করছেন, মনেই তো হয়নি যে এরা ওই বাড়ির আদতে কেউ নন। সবাই অভিনেতা! যা মনে হয়নি, তা নিয়ে বলি কেমন করে?
তবে বলি আর একটা কথা। শ্রদ্ধা। পুরো ছবিটাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে এক ছবির জাদুকরের প্রতি আরেক ছবিওয়ালার শ্রদ্ধা। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার এক জাদুকরী মিশেল ছবিটায় পরতে পরতে।
যাঁরা ছবি ভালবাসেন, তাঁরা তো এমনিই দেখেন, যাঁরা আমার মতো হঠাৎ হঠাৎ সিনেমার ডালে বসা পাখি, তাদের কাছে বলার - সময় করে একবার দেখে আসুন। সহজ কথা সহজ ভাবে বলতে শুনতে মানতে চাইলে একবারটি দেখে আসুন।
তবে বিধিসম্মত একটা কথা -আমি তো ছবির ক্রিটিক নই, কাজেই যারা ক্রিটিক রয়েছেন, অথবা গোদা বাংলায় যাদের বলা যেতে পারে একেবারে আগ মার্কা ইন্টেলেকচুয়াল, তাঁদের কেমন লাগবে সে কথা তাঁরাই বলতে পারেন। তবে আমার মত পাতি, কম পড়াশুনো করা কেবলমাত্র দৃশ্য দেখে দৃশ্যটাকেই ভালো লেগে ভালোলাগার সেই সহজ কথা সহজ ভাবে বলতে পারা যাদের অভ্যাস, তাদের ভালো লাগবেই -এটুকু বলতেই পারি। কাজেই , যান দেরি না করে দেখেই আসুন।
গৃহপ্রবেশ
কৌশিক গাঙ্গুলী, শুভশ্রী গাঙ্গুলী, সোহিনী সেনগুপ্ত, রুদ্রনীল ঘোষ, জিতু কামাল, স্নেহা চ্যাটার্জী অভিনীত ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তর ছবি
রচনা, সঙ্গীত , পরিচালনা - ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত
সম্পাদনা - সুজয় দত্ত রায়
আর্ট ডিরেক্টর - রনজিৎ ঘোরাই
প্রযোজনা - সমীরণ দাস
Comments
Post a Comment