Skip to main content

মেসকুটুম্ব

 



মেস বাড়ি ভারি মজা, কিল চড় নাই- আম জনতার কিন্তু এটাই ধারণা। মেসবাসীরা কেউ কেউ হয় তো হাঁউমাউ করে উঠবেন; হয় তো বলবেন, ‘ বাইরে থেকে ওরম বলাই যায় দাদা, থেকে দেখুন কত ঝক্কি!’ তা সে তো বটেই। ‘সমুদ্র যাত্রায় যে কত যন্ত্রণা, সে কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন’। এ তো ক্লাস ফাইভ থেকে ধ্রুব সত্য। কিন্তু এটাও তো ঠিক, অন্য লোকের সমুদ্রযাত্রার ছবি- দিগন্তের নীলে ডুব দেব দেব নিটোল গোল কমলা লেবু…মেঘ আর জলে তার ছোঁয়া মিশে একাকার…নাম না জানা পাখির পালকে তার রঙ- বলুন, মন টানে না? তবে?

আসলে, মেস হল এমন এক মামাবাড়ি যেখানে ঘাড় ধরে নামিয়ে দেওয়ার কেউ নেই, কানটি ধরে মুলে দেওয়ার কেউ নেই, রাত দুটোয় যেখানে কাপড় কাচতে গেলে কেউ ঝামটা দেয় না, দেরি করে উঠলে মহাভারত থমকে যায় না। পেপার পেতে হাতের মুঠোয় মুড়ি চানাচুর আর কাঁচা লঙ্কার ঝাল যেখানে বিরিয়ানির সোয়াদ দিতে পারে। প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের ঘাম, তিরিক্ষি বসের ঝাল, প্রেমিকার সেন্টু- সব কিছু জাস্ট গপ করে গিলে নিতে পারে- কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আগুন জ্বেলে ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ফুঁকে দিতে পারে।

মেস মানে হল আড্ডা। নির্ভেজাল, নিঃস্বার্থ আড্ডা। পড়তে পড়তে আড্ডা, হিসেব মেলাতে মেলাতে আড্ডা, বাজার করতে করতে আড্ডা, লোডশেডিং এ আড্ডা, আলো জ্বললে আড্ডা, খোলা ছাতে আড্ডা, চওড়া সিঁড়িতে আড্ডা। খেতে খেতে, ঘুমোতে ঘুমোতে এমন কি লাগোয়া টয়লেটে বাহ্যকালেও আড্ডা! আড্ডার হরেক রঙ, হরেক বৈচিত্র্য!
কখনও সখনও মাঝবয়েসী মেস মালিকও এসে জোটেন সে আড্ডায়। তাস পড়ে। অ্যাশট্রের নামে এনামেলের বাটি নয়তো ওষুধের বাক্স নামে, চায়ের ধোঁয়ায় আড্ডা জমে ক্ষীর। তখন তিনি আর গৃহস্বামী নন, কুটুমও নন, বরং বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ। মেসের আকাশে মেঘ জমলে তিনি কখনও সখনও আদি রসের ফুলুরি ভাজেন..সমস্বরে কলরোলে তখন গুরু বন্দনা হয়! আবার আষাঢ়ের ঝর ঝর মুখর সন্ধ্যায় চৌকিতে আধশোয়া হয়ে লোডশেডিং এর আবহে হাতের বিড়িতে জম্পেশ টান মেরে যখন শুরু করেন আষাঢ়ে গপ্প- ছমছমে রাতে বিড়ির লাল আগুন জোনাকির মত জ্বলে…পলেস্তারা খসা দেয়ালে মোমের আলোয় শ্রোতাদের ছায়াগুলো কাঁপে!
তবে ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’! মেসও তো আদতে সংসার। ছড়ানো ছেটানো বাসন কোসনে তো ঠোকাঠুকি লাগবেই। শব্দও হবে। সেই তো জীবন। সামান্য বিষয়ে হয়তো তুমুল ঝগড়া লাগবে, নয়তো কিছুই হবে না; কেবল ঝড় ওঠার আগের মত থমথম করবে আকাশ! তারপর অনুনাদী গর্জন শেষে বর্ষণ হলেই খিলখিলিয়ে উঠবে সবুজ।

আর যদি বর্ষণ না হয়, তবেও প্রকৃতির নিয়মেই বৈশাখের বিড়বিড়ানো গরমের ত্রাতা রূপে সন্ধেবেলা ছুটে আসবে হয়তো কোনও ঠাণ্ডা হাওয়া। তৃপ্তির শীতলতা ছুঁয়ে দেবে মন। দল বেঁধে হাওয়ায় এসে বসবে দগ্ধ চাতকেরা। কত কি ঘটে যাবে তারপর, সে সব শোনা কওয়ার আগে ফাঁকতালে এই বেলা বলে রাখি, সেই হাওয়ার মেসওয়ালি নাম গেস্ট আর আদুরে নাম কুটুম।

মেসে গেস্ট এলো মানেই ‘ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে’। তো ননদীর সাথে যতই ঠোকাঠুকি থাক গে যাক, জামাই এলো তো আর দু মুঠো চাল হাঁড়িতে দিতেই হবে, মাসিকে নয়তো ঠাকুরকে বলে মেনুতে দুটো পদ বাড়াতেই হবে, গেস্টকে নিয়ে সব্বাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিতেই হবে। নইলে কুটুম ভাববে কি! মেসের একটা সম্মান আছে না?


কাজেই কুটুম কার সে কথা বড় নয়, এলো যখন,। তখন গোটা মেসের। যার গেস্ট, দেখা যাবে সে হয়তো সারা দিন ধারে কাছেই এলো না, কাজে কম্মে টো টো করল, অথচ তার কুটুম অ্যাটেন করতে রোটেশানে ডিউটি দিয়ে চলল আর সব বোর্ডাররা।

গেস্ট অবশ্য প্রায়শঃ আসেন পরীক্ষা নয়তো ইন্টারভিউ দিতে। কষ্ট করে এসে ওঠাটুকু কেবল, বাকি সব দায় নিয়ে নেবে মেস। কীভাবে যাবে, কোন বাসে উঠবে, কোন স্টপেজে নামবে, সকালে কটায় উঠতে হবে সব কিছু ছকে দেবে। ভাবা যায়!

আবার আর এক রকম গেস্টও আসেন। উদ্বাস্তু। হয়তো ক্লাস শুরু হয়ে গেছে নয়তো চাকরি স্টার্ট, অথচ থাকার ঠাঁই মেলেনি কোথাও! উদ্ভ্রান্ত, বিভ্রান্ত! হয়তো হঠাৎ দেখা মেসের কোনো দাদার সাথে, নয়তো ছোট্ট একটা ফোন। ব্যস! হিল্লে হয়ে গেল। চওড়া বুকে টেনে নেবে মেস। যতদিন না নতুন ঠাঁই খুঁজে দেওয়া যায়, হাসি মুখে ভাগ করে নেবে আড়াই ফুটের বিছানা।

অবশ্য আরও এক ধরণের গেস্টও হন। ‘প্রেম যমুনায় হয় তো কেউ ঢেউ দিল, ঢেউ দিল রে’। আর ঢেউয়ের দোলায় দোল দোল দুলুনি সেই রাঙাবাবু বা, রাঙাদিদি দয়িতের সাথে অ্যাপোর টানে মেসের দরোজায়। ‘ডেটিং করতে বেলা গেল, মা গো মা!’ তো কী আর করার! হাত উঠাও, ফোন ঘুমাও, সিটি বাজাকে বোল- ভাইয়া ফেঁসে গেছি! ব্যস! মেস তোমার ছাতা! এরা মেসে বেশ কমন কুটুম। বেশ খিল্লিও জমে এদের নিয়ে। রস একেবারে টপকে টপকে পড়ে। কথায় বলে, প্রেমের ঘোর এমনই ঘোর যে মহা ঘোড়েল লোকও ক্যাবলা বনে যান। কাজেই প্রেমিকের প্রেম ঘিরে মেসে গপ্প জমে, চাটন জমে। ‘কে প্রথম কাছে এসেছে’, কে প্রথম…মাখো মাখো গপ্পে জমে যায় রাত আড্ডা। প্রেমিকেরও অবশ্য জুটে যায় নতুন বন্ধু, নয়া কাঁধ, যে কাঁধে অনায়াসে নামিয়ে রাখা যায় মাথা।
তবে কপালে যদি জোটে সেই ‘সাড়ে চুয়াত্তর’এর মত আয়েশি কুটুম, ট্যাঁকে যার সুচিত্রা সেনের মত মার কাটারি সুন্দরী- হা গোবিন্দ! ট্র্যাজেডির ফুল ফুটে যায়। ইলিয়াড ওডিসি মহাভারত রামায়ণ সব কিছু ঘটে যেতে পারে! ‘মাসিমা, মালপো খামু’ থেকে শুরু করে মেসের ছাতে ম্যারাপ বেঁধে মালা বদল পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে, সে তো আমরা জানিই! তবে সব কিছুর শেষেও ওই আদি অকৃত্রিম বন্ধুত্ব আর আড্ডা মাথা উঁচু করে ওঠে।

এর নামই তো মেস। এই তো তার গর্বের ঐতিহ্য! এই তো তার যেমন খুশি ছড়ানো ছেটানো ছোট্ট ভুবন। আহা! যদি বাইরের ভুবনটিও এমনই স্বাদে আহ্লাদে ভরা অনাবিল আনন্দের মেস হয়ে ওঠে, সে মেসের মেসিদের সখ্যতায় আর প্রয়োজনীয় ড্রিবলে কত না সুন্দর হয় দিন! ঠিক কি না, বলুন?

12.06.2016 তারিখে কলকাতা24x7.কম এ প্রকাশিত 

Comments

Popular posts from this blog

অহনা আলোর পথযাত্রী- এখানে থামবে না

   অহনা - The Light Within ওই শেষের কথাটিই ছবির সুর। মন ছোঁয়া সুর। লালন সাঁই এর গানে মায়াময় এক দৃশ্য মিশে যাচ্ছে। উত্তরণ। উত্তরণের অভিযাত্রা। মানুষের পরিচয় মানুষ। নারীবাদিতার ট্যাগ আঁটলে এ ছবির সাথে খানিক অনুচিত হবে বলেই এই সামান্য কলমচির অভিমত। কথা বলছিলাম প্রমিতা ভৌমিক লিখিত, পরিচালিত, প্রযোজিত ছবি 'অহনা' নিয়ে। অভিধান বলছে অহনা শব্দের অর্থ উষা, দিনের প্রারম্ভ, উজ্জ্বল। আর ছবি বলছে অহনার ভিতরের রাত কেটে ভোরের কাছে যাওয়ার গল্প। গল্প চেনা। আশপাশে তাকালে- আশপাশে কেন পরিবারে তাকালেই চোখে পড়বে এমন গল্প। গল্প বলা- স্পয়লার দেওয়া আমার কাজ না। কাজেই দিলাম না। কেবল এটুকু বলি অহনা সমাজের সংবেদনশীল এক মেয়ে। লেখক। লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক। অধ্যাপক স্বামী, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শ্বশুর আর কাজের মানুষ নিয়ে গোছানো সংসার তাঁর। অন্তত বাইরে থেকে তো তেমনই মনে করা যায়। খুব ভুলও নয়। না , এটা বলাই আমার ভুল হলো- সংসারের, পরিবারের ভিত যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা- অহনা আর তাঁর অধ্যাপক বরের মধ্যে সেইটিরই অভাব। বড় অভাব। অভাবের কারণ অবশ্য লুকিয়ে শরীর ছুঁয়ে মনে। সমাজ ছুঁয়ে মনে। দ্বন্দ্ব ছুঁয়ে সম্পর্ক...

যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ !

  স ত্যিই যুদ্ধ। যুদ্ধ বলে যুদ্ধ! চোখের সামনে যুদ্ধ, নায়কে খলনায়কে যুদ্ধ, দেশে দেশে যুদ্ধ, গানে Gun-এ যুদ্ধ, কানে কানে যুদ্ধ, মনে মনে যুদ্ধ। ধিম ধুম ধাসুম গুদুম গাদুম - বোম পড়ছে, গ্রেনেড পড়ছে , বাড়ি উড়ছে, গাড়ি উল্টচ্ছে, গাড়ি গুঁতোচ্ছে , হেলিকপ্টার উড়ছে, জেট উড়ছে, জেড নিরাপত্তা বুড়ো আঙুল দেখছে, আঙুল চুষতে চুষতে চোর ঠেঙান ঠেঙাচ্ছে হিরো - সব কুছ আরামসে! আরি বাপরি বাপরি বাপ! ওয়ান ম্যান আর্মি - আরি বাপরি বাপরি বাপ!  পুরো বিনোদনের ক্যাপসুল! ক্যাপসুলে কি নেই? তিন ঘন্টার মধ্যে জগত দর্শন! ওরে বাপরে মার কাকে বলে? অবশ্য শুধু মার বললে ভুল হবে। প্রেমের জোয়ার আছে, প্রেমের জোয়ারে দোহার ভেসে যাওয়া আছে। স্পাই ভার্স বলে কথা- কাজেই সুন্দরী নায়িকার স্বল্প বসনে হাঁটাচলার আবেদন আছে, মনে ঢেউ তোলা নাচন আছে। আর সর্বোপরি- গ্রিক গড হৃত্বিক রোশনের নাচ আছে! আর কি চাই? দীপিকা?  পুরো ছবিটাতেই তো হৃতিক রোশন আর হৃতিক রোশন! অবশ্য এন. টি. আর. তাঁর কামাল দেখিয়েছেন। হৃতিকের পাশে নাচার সময় চোখে পড়ে এমন মানুষ বলিউডে এখনও খুব কমই আছেন। এন. টি. আর তাদের একজন। ছবিতে হৃতিকের সাথে প্রায় সমান...

গৃহপ্রবেশ- ভালোবাসার ঘর দুয়ার

 শাশ্বত কর  গরম কোন পর্যায়ে সে তো আর বলা না বলার ধার ধরে না। ঘামে ঘামে বাসে ট্রামে সবাই টের পাচ্ছে। একটা কাজে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ করে ঘণ্টা চারেকের অবসর পেয়ে গেলাম। অবসর বটে কিন্তু চাআআর ঘণ্টা এই তুমুল রোদে করি কী? সময় বদলেছে। এমন প্রখর দাবদাহে পথিক কি খুঁজতেন? খানিক গাছের ছায়া, তৃষ্ণার জল- এই তো!  আমার কাঁধের ব্যাগে জল, নাকের ডগায় মাস্ক, মাথায় কপালে রোদ্দুরের তেজে গলন্ত স্বেদ। মাথা চিড়বিড় করছে, পেতে ছুঁচো না হোক কেউ তো ডন দিচ্ছে। এই তুমুল আলোয় সত্যি সত্যি চোখে ঝিলমিল লেগে যাচেছ। সামনে অজস্র খাবারের দোকান, চায়ের দোকান। সেসব ছেড়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসে খোলা মাঠ দেখে সময় কাটাব ভাবছিলাম। চোখে মুখে রোদেল হাওয়ার কঠিন চুম্বনএর ঠেলায় সইলো না! বেরিয়ে এলাম। দক্ষিণ কলকাতার ফুটপাথ। গাছের ছায়ার অভাব নেই, অভাব নেই রোদের দীর্ঘশ্বাসেরও! খানিক উদভ্রান্ত পায়চারির মধ্যেই মরূদ্যানের মত একটা সিনেমা হল। আর পায় কে? টিকেট উইন্ডোতে টিকিটের দাম দেখে খানিক আশ্বস্ত হলাম। এখনো ১১২ টাকায় সিনেমা দেখা যেতে পারে !এই দুপুর রোদে ১১২ টাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসার আরাম। এই ভয়ঙ্কর আশ্র...