‘চৈত্র মাসের দুপুরবেলা উদাস হাওয়া বয়/ দস্যি ছেলে ঘুরে বেড়ায় সকল পাড়াময়’ মায়ের ঘুমপাড়ানি গান। লিখতে বসে গানটা মনে পড়ায় এই বয়সে একটু
হাসিই পেল। ইচ্ছে হল মাকে ডেকে বলি, শোনো মা, দস্যি ছেলেই শুধু নয়, মিষ্টি মেয়ে বা শান্ত সুবোধকেও কিন্তু
এই চাদিফাটা চিড়বিড়ে চৈত্রে কাজে কম্মে রাস্তায় রাস্তায় টো টো করতে হয়। ফলঃ জীবন একেবারে ভাজা ভাজা- মাথা থেকে ঘাম ড্রপ খাচ্ছে সিধে পায়ে। ওফ! সুয্যি মামা পারফেক্ট বিজ্ঞাপনী ধাঁচে
একেবারে স্ট্র লাগিয়ে শুষছেন। বাঁচাও মধুসুদন! মধুসুদন কে র্যা? কে আবার, জল। কিন্তু পথে ঘাটে মিলবে কোথায়? স্পণ্ডালাইটিস সত্ত্বেও যে আপনি আপন
ভার নিজ কাঁধে বইবেন, তাতেও কত গেরো। গাদাগাদি ট্রেনে, বাসে কমেণ্ট ভাসবেঃ ‘ও দাদা, ব্যাগে কী!’ টুকরো ফোড়নে কলহের ফুট, ‘ব্যাগে বোম, তারক বোম’, নয়তো গালভরা এক্সপার্ট কমেন্ট ‘ এদের এই দামড়া ব্যাগের জন্যে আর পাঁচটা
লোক উঠতে পারে না’- বঙ্গজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ!
যাই হোক, এরকম একটা ‘দীর্ঘ দগ্ধ দিন’এ নিটোল একটু শীতল ছায়া, চলমান মর্মছোঁয়া মায়ার নাম ঃ ছাতা। হিউয়েন সাঙ জানেন এ ছাতার কী মাহাত্ম! আর জানে আমার আপনার ছেলেবেলা। এক ছাতা, তার কত না কাজ বলুন! রোদ্দুর বৃষ্টি তো ছেলেবেলায় এলেবেলে। ছাতা মানে বন্ধুর পায়ে লেঙ্গি, খিলখিলে হাসি; ছাতা মানে টিফিন বেলা হকির নামে গুঁতোগুঁতি; ছাতা মানে ভিতরে জল ভরে সেই ছাতা অন্যকে
দিয়ে খোলানোর দুষ্টুমি; ছাতা মানে উঁচুডালের কাঁচা আম হাতের মুঠোয়; ছাতা মানে বর্ষা দিনের ‘ছই ছপা ছই’, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জল ছেটানোর মজা; ছাতা মানে পুকুর-নদী ভাসা মাঠে হঠাৎ পাওয়া কই ট্যাঙরার
পাত্র! ভেবে
দেখুন, নর্দমা
ছেঁচে ছাতা দিয়ে স্রেফ তেচোখা বা গাপ্পি ধরতেও কিন্ত ছেলেবেলা পিছ পা নয়।
তবে যে অভিধান যাই বলুক না কেন, ছাতা আসলে আশ্রয়। নিরালা- নিবিড়- একান্ত আপন। একটু বড় করে তাকালে, এই ডান্ডি সর্বস্ব ঘরখানার কত না ব্যাপ্তি!
‘ক’ বাবুর কথাই ধরুন না। আমিও চিনি, তুমিও চেনো, চিনেও না চিনলে চলে এমন একজন। পারফেক্ট ‘কমন ম্যান’। টেনিস বলের মত এপাশে ওপাশে বাড়ি খেতে
খেতে পঞ্চান্নটা চৈত্র পার। ঝুলন্ত লাউয়ের মত মুখে ডিপ্রেশানের পার্মানেন্ট জ্যামিতি। কামিনী কাঞ্চনের গুঁতোয় যাকে বলে একেবারে
হাই ক্লাস দিশেহারা। অফিস ফেরতা কালিবাড়িতে বসেন। প্রায়ই। সন্ধ্যারতি হয়। শূন্যচোখে দেখেন। হারমোনিয়াম বাজে, দুধ শাদা ধুতি ফতুয়া গায় ‘ এ মায়া প্রপঞ্চময়...’ চোখ জ্বললেও রোদে পোড়া মন একটু ছায়া
পায়। বলুন তো, এই সন্ধ্যারতি ‘ক’ বাবুর ছাতা নয়?
একবার নিজের দিকেই দেখুন না কেন? চরম সেণ্টু খেয়ে বুক ভরা ইমোশনের সাগরে
ভেসে আপনি যখন রবীন্দ্রনাথের গানে কম্পলিট মজে যান, কথা সুর ভাব সব মিলে মিশে অনুভবের ছাতা হয়ে দাঁড়ায় কি
না?
তবে ব্যাপ্তির কথা বলেছিলাম না, খুব কমন অর্থে ছাতা একরকম অস্ত্র। ছোটবেলার হোস্টেল বা স্কুলের কথা মনে
করুন- কর্পোরাল
পানিশমেন্ট তখনও ব্যাণ্ড হয়নি। ফলতঃ দস্যিপনার শাস্তি বেত্রাঘাত, বেতের অভাবে ছত্রাঘাত। ছাতাপেটা। হাতিরাম পাতির ছাতা তো এব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। কাপাস ধোনা ধুনে দিতে জানে। আবার বড় হয়েও মেয়েদের হাতে ছাতাপেটা
হতে দেখেছি কলেজ ইউনিভার্সিটিতে। হতে পারে তা খুনসুটির, কিন্তু তাতে ছাতার মাহাত্ম কমে না।
ছাতা আবার স্টাইল স্টেটমেন্টও বটে। রঙিন ছাতায় রং মিলান্তি। নীলা কুর্তি- গুলাবি চুনড়ি মায় মভ ঠোঁট পালিশের সাথেও
মানানসই রঙিন ছাতা না পেলে তন্বী কুমারীর তুম্বো মুখ দেখতে হয়, এ একেবারে দিনের আলোর মত সত্য। আবার রঙিন ছাতাকে এদিকে ধরে ওদিকে পাকড়ে
কত মডেলের কত রকমের পোজ, খিচিক খিচিক ক্লিক! বিশ্ব নিন্দুক বিশু বোসও যদি হন তবু
আপনাকে স্বীকার করতেই হবে। পরিচিত এক ছাতাবিক্রেতার কাছে শুনেছি, শ্রীদেবীর হাতে ছোট্ট সাদা ছাতা দেখার
পর তার বিক্রিবাট্টা কী পরিমাণ বেড়েছিল!
ছাতা আবার কলহের পাঁচফোড়ন। চিনেদের প্রবাদঃ ঘরে ছাতা ফোটালে দুর্ভোগ
ইজ ডান্সিং অন ইয়োর ফোরহেড। আর ছাতা হারালে? জ্জয় ত্তারা! ‘ আজ আবার? রোজ রোজ হারিয়ে আসে অপদার্থ লোক’! ব্যাকগ্রাউণ্ডে বেহালা আর ড্রামসেটের
ঝাঁকানাকা ফিউশান। এ ছাতা বড্ড অভিমানী! একটু কম পাত্তা দেবেন তো গুমরী গার্লফ্রেণ্ডের
মত ভাগলবা, না পাওয়ার
চান্স শতকরা একানব্বই ভাগ। কারণ কি জানেন, ছাতা হারানোয় যেমন দুঃখ, তেমনি
পরের ছাতা পাওয়ায় পার্মানেন্ট পরকিয়ার সুখ। ক জন ছাড়তে পারে, বলুন?
বাংলা ছবিরও কত বিখ্যাত সব ছাতা,
তাই না? সুচিত্রা সেনের ছাতা নয় একপাশেই রাখলাম। তাছাড়া তুলসি চট্টোপাধ্যায়ের ছাতা
নেওয়ার ওই ধরণ, অহো! একেই বুঝি বলে অভিনয়! নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের ‘ আকাশভরা
সূর্যতারা’ দেখা যায় এমন সছিদ্র ছাতা! ওই, নৃপতিবাবুর কথায় মনে পড়ে গেল একটা
দৃশ্য- ছুপি দিয়ে মেয়ে দেখা ঘটকের পশ্চাদ্দেশে মহানায়কের ছাতা দিয়ে গুঁতো...আরিল্লে!
একেবারে পিলে চমকানিয়া। অথবা হীরকরাজের মন্ত্রীর পিছন পিছন ছত্রধারকের সছত্র
অস্থির পদচারণা! অকৃত্রিম। সময় পার করেও বেঁচে থাকে এমন সব দৃশ্য! একসে বড়কর এক!
এহেন বিচিত্র ছাতার সনে কিন্তু প্রেমের
মাখোমাখো সম্পক্কো। অই, পাপি মন নিশ্চই ছাতার আড়ালে একটুকরো
টিনেজিয়ান রোমান্সের ‘ভিক্টোরিয়া (মেমোরিয়াল)’ন সংস্করণ ভাবছে? ‘ ছাতায় ছাতায় যে
রাত হয়ে যায়, কী কথা রাখলে বাকি?’ তাই না? কেনরে বালাই, আর কিছু চোখে পড়ে না? আর
কিছু মনে পড়ে না? ঝিরঝিরে জল, ছাতার আড়ালে দুটো মাথা- ছাতার বাইরে দুটো আনন্দঘন
ডান্সিং পা-‘পেয়ার হুয়া, ইকরার হুয়া’- গুরু কবে থেকে তো জমে ক্ষির। বাজে কথা
ভাববেন না, আমি শ্রী ৪২০-র রাজ কাপুরদের কথাই বলেছি, অন্য কোন ইঙ্গিত নয়। অথবা
ধরুন, স্বচ্ছ ছাতার নীচে হিরোইন, ওদিকে ঝরঝরিয়ে নামছে জল। জলে ছ্যাঁকা! ‘পুড়ে যায়
অধরোষ্ঠ’- ‘মনে পড়ে আনোয়ার’? অথবা বিকেলের পার্কে তুমুল বর্ষণ। ছাতায় নারী। দমকা
হাওয়ার দুষ্টুমিতে ছাতা যদি উল্টোয়, ‘জলছবি হেঁটে যায় দুচোখের মাঝে’। হাঁটে কিনা?
অথবা অঞ্জন দত্তের সেই গান, ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে, সাথে থাকবেন কোন ছাতা...’,
ঠিক কি না, প্রেমিক, তুমিই বল!
গোড়ার দিকে আশ্রয়ের কথা বলছিলাম না,
একটা ছবি মনে পরে গেল। গত বছর জুলাই টুলাই হবে। দমদম আণ্ডারপাস। এক পশলা হয়ে গেছে
খানিক আগে। এখন ঝিরঝির। অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়েই ডানপাশে দেখলাম, ভবঘুরে এক
বৃদ্ধা- বাম হাতে ত্রিভঙ্গ শতছিন্ন ছাতায় আড়াল করে ডান হাতে আদর করে ছাতুর গুলি
খাওয়াচ্ছেন খাঁচায় রাখা দুটো পাখির বাচ্চাকে। ওরা কাক না বক ভিজ সপসপে পালকে আর তা
বোঝা যায় না। বৃদ্ধা নিজে কিন্তু পুরোটাই বৃষ্টিতে। ওঁর ভিজে চুল থেকে টপটপ করে জল
ঝরতে দেখে ইন্দ্রনীলের কথা মনে পড়ে গেল। আমার কাঁধে ওর মাথা। কাঁধটা ভিজে যাচ্ছে।
কাকুকে বের করে নিয়ে গেল আত্মীয় স্বজন, আর ইন্দ্রনীল ডুকরে উঠল, ‘মাথার উপর থেকে
আমার ছাতা চলে গেলরে!’
প্রকৃতিও যে কখন কী কথা মনে করায়
না! ছাতার মাথা, ভাল্লাগে না!
‘রবি’, খবর ৩৬৫ দিন
( ৬ই এপ্রিল, ২০১৬)- তে প্রকাশিত
Khub sundor sir...... r o chai amn lekha....
ReplyDeleteThank you...bhalo thakis
ReplyDeleteThank you...bhalo thakis
ReplyDelete