Skip to main content

‘শালা’-র সাথে পানশালায়

‘শালা’-র সাথে পানশালায়

শাশ্বত কর



‘ডাক পাঠালে আজ সকালে/ আর কি দূরে থাকতে পারি?’ তাছাড়া ডাকেরও তো রকমফের আছে। ‘যে বলে আয় লো, তার সনে যাই লো’ তো আর হওয়া যায় না! সেলফ রেসপেক্ট, সেলফ এস্টীম-এই স্টিমী, ভোলেটাইল জিনিসপত্র, কত সব আছে না! তবে?

তবে এ ডাক তো আর যে সে ডাক নয়, খোদ বসের ডাক! টাক যেমন চকচকে লোকটার তেমনই জয়ঢাকের মত বপু! আর কী পালিশ রে ভাই! মালিশ খাওয়া তেলতেলে স্কিনে মাছি বসার জো নেই! বসলেই স্লুৎ করে পিছলে যাবে! কাঁচা মাখনের মত রঙ! বঙ্গসন্তানের এ হেন বপু আর মেজাজ খুব একটা সুলভ নয়। সুলভ কম্পলেক্সে জলাল্পনা দেওয়া আয়নার সামনে চুলে চিরুণি বুলোতে বুলোতে ঠিক এই কথাগুলোই ভাবছিলুম।
ডাক এসেছিল বিহান বেলায়। পাশের ফ্ল্যাটের মিত্তিরদার বেয়ান তখন রেয়াজ করছেন। রেয়াজি খাসির মত তার স্বর। তারস্বরে একেবারে তাল ঠুকে চিল্লাচ্ছেন। তিতিবিরক্ত হয়ে চায়ে দাঁত ডোবালুম। ধুত্তোর! লিকার বেশি হয়ে গেছে- তিতো! ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা, ছ্যাঃ! রামোঃ! খবরের কাগজটা খুললুম, প্রথম পাতা জুড়ে নিমের ফেসওয়াশ! এ হে হে! গোটা দিনটা তিতো আজ হবেই! মর্নিং শোজ দ্য ডে- কথায় বলে না! বলে কি আর সাধে? হাজার হাজার পরীক্ষালব্ধ সিদ্ধান্ত এ সব। কাজেই নড়চড় হয় না খুব একটা। হলও না। খানিক্ষণের মধ্যে মোবাইলের বুকে ভেসে উঠল বসের মাকুন্দ মুখ। বুঝলুম, হয়ে গেল। তিতো গলায় বললুম, ‘ গুডমর্ণিং বস!’

‘ মিইয়ে আছো কেন সাত সকালে? চিয়ার আপ, পদ!’

পাপী ঠোঁটে বস আমার হরির নাম আনতে পারেন না। হিরণ্যকশিপুর পুনর্জনম! চেহারাপত্রে তো অবশ্যই খাপ খেয়েই যায়। কাজে কাজেই, মাইনাস হরি, কেবল পদ বলেই ডাকেন।

‘ না ঠিক আছে, বস। দেখুন না, আপনার কথায় কেমন গিয়ার দিয়ে চিয়ার আপ হয়ে গেছি’।

ওঃ! হাসি দেখোনা, অসুরের বাবা! হাসির গুঁতোয় কান একেবারে খুঁতো হওয়ার জোগাড়! হাসি থামলে, সামলে নিয়ে বস বললেন, ‘শোন পদ, আজ আর আমি আসছি না’

‘ আরে তাতে কী হয়েছে বস! আমি তো আছি। আপনি ওদিকে রেস্ট নিন, রোস্ট খান, দোস্তকে ডেকে হল্লা করুন- ঝিল্লির কী আছে! আমি এদিকে সব ম্যানেজ দিয়ে দেব’

‘ সে আমি জানি, পদ। তবে তোমার কাজ আর একটু বাড়বে আজকে’।

‘ কি হল বস? বসে গেছে নাকি  কোনো কেস?’

‘ আরে ধ্যাৎ! শোনোই না আগে! আমার শালাটি এসেছেন। ওকে নিয়ে একবার যাব বিকেলে। তোমাকেও যেতে হবে। না করতে পারবে না’।

বস আসছে না শুনে যে খুশিটা ঘাই মেরেছিল, ধাঁই করে সেটা ডুব দিল অতলে। বললুম, ‘আমি আর কেন, বস? এদিকে এত কাজ?’

‘ হ্যাং ইয়োর কাজ, ম্যান! ঘ্যান ঘ্যান না করে বিকেল পাঁচটায় চলে এস’

‘ কোথায়?’

‘ কোথাও না, পদ। অফিসের বাইরে এসে দাঁড়িও। আমি তুলে নেব’


আপনি কেন, ঈশ্বর এসে তুলে নিলে আমি আরও খুশি হতুম! শালা এসেছে তোর, তুই যাবি তাকে নিয়ে পানশালায়, তাতে আমায় নিয়ে টানিস কেন রে বাপু? ভাল্লাগে না ছাতা!

ছাতাটা ব্যাগে নিয়ে একটু আগে আগেই আজ অফিস গেলুম। আগাগোড়া মধ্যমনস্ক মানুষ আমি। পান বলতে রেগুলার খাওয়ার শেষে মিঠা পাতায় কুচো সুপুরি আর চ্যবন দিয়ে খাই। আমায় কি না পানশালায় আমন্ত্রণ! তাও বসের শালার অনারে! জনারেই তো আসি না! বসকে আর কে বোঝায় তা!

অবশ্য এ জন্যে আমিও দায়ি অনেকটাই। দিন তিনেক আগে যখন বস বলছিলেন, ‘ বুঝলে পদ, শালার সাথে পান করলে আয়ু বাড়ে। আর যদি পানশালায় সেই পানক্রিয়া হয়, তবে যমরাজও পারমিশান নিয়ে তারপর দূত পাঠায়’- হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়েছিলুম। মিলে সুর মেরা তুমহারা। তাতে যে নয়া সুর বনেছে, তার দায়ও তো তাই নিতেই হবে।

অবশ্য পানশালায় যে একেবারে কোনোদিন ঢুঁ মারিনি, তা তো নয়! হাতে গুণে দু’বার গেছি। তবে সে সব জায়গায় শ্রেণিবৈষম্য ছিল না। এখানে যে কী ঘটবে ভগা জানেন।

প্রথমবার মধুশালায় হাজির হয়েছিলুম দুই দাদার সাথে। গৌতমদা আর দাদা। আমি মধ্যম হতে পারি, তবে এ দু’জন একেবারে উত্তম গোত্রের। অথচ তফাতে চলার কোন ব্যাপার নেই। উত্তম মধ্যম একই সাথে ওঠা, বসা, খানা। পিনা বাকি ছিল, কাজেই হাজির হয়েছিলুম পানশালায়- মহারাজা তার নাম। ঢুকতে যেতেই সান্ত্রীর অভ্যর্থনা। দরবারে সার সার আসন। তাতে সব রাজা গজারা বসে। সামনে আলেকজান্ডারের পানপাত্রে সোমরস। আমাদের স্থান হল দরবারের মাঝমাঝি। পিছনে বিস্তৃত ঝালরে কড়ি দুলছে মৃদু হাওয়ায়। সামনে দেয়ালে ঝুলে এল.সি.ডি.র ওই মাঠে খেলায় মেতেছে দুই দল- মোহন বাগান- ইস্টবেঙ্গল। এই রে! বুকের ভিতরটায় ধড়াম করে বাড়ি পড়ল। আজ একটা অঘটন ঘটবেই। আমার দাদা দু’জন দু দলের উত্তম সমর্থক। উত্তম বলে উত্তম! গোদা বাংলায় যাকে বলে একেবারে ডাইহার্ড সমর্থক। আজ টিকিট মেলেনি বলে মাঠে যায়নি। সেমি ফাইনাল। দুজনেই দুঃখ ভুলতে এসেছে পানশালায়। সেখানে সরাসরি সম্প্রচার! কাম সারসে!

খেলার বারো মিনিট। বারোটা বাজতে বোধ হয় আরও একটু বাকি। দুজনেই স্পিকটি নট। ঠোঁটে পেয়ালা, চোখে মাঠ। এই রে! রেফারিটার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই! ইয়েলো কার্ড! ব্যস! খেল শুরু! গুরু, সে যা কেত্তন, সে আমিই জানি। দু মক্কেলেরই জিভে কথা হোঁচট খাচ্ছে। আমার কথা ছেড়েই দিলাম। কেমন নির্লিপ্তি পেয়ে বসেছে। কেবল দেখছি। দুজনের মুখে খই ফুটছে। তত্ত্ব, তথ্য, বিশ্লেষণে গমগম করছে দরবার। আপন আপন রাজ্য ছেড়ে আরও কয়েকজন রাজা এসে যোগ দিয়েছেন বিতণ্ডায়। ব্যাপারটা কী! সবাই! ‘সাকী নে কুছ মিলা না দিয়া হো শরাব মে’! আরে! সাকীরাও তো দেখি হাজির! তারাও দু দলে ভাগ! পরিষ্কার দুটো গ্যালারি হয়ে গেছে। মাঝখানে এল.সি.ডি. মাঠ। আমি রেফারি। আর শূঁটকে পাঁশুটে ম্যানেজার লাইন্সম্যানের মত মাঝে মাঝে দৌড়ে আসছে। সে এক মস্ত দিন।

দ্বিতীয়বার অবশ্য আলাদা ব্যাপার। ততদিনে একটু সাবালক। কাজেই সাঙাতের সাথে মিলে ঠিক করেছি আজ যাওয়া হবে। সে মত দুজনেই কাজ ফেরতা জুটেছি এসপ্ল্যানেডে। সাঙাতের অবশ্য নাম নেব না। বলা যায় না, দাম্পত্য কলহে ফুসকুড়ি দেয়ার দায়ে শ্রীঘরে যেতে হতেও পারে। বলা তো যায় না, কোন গুপ্তচরের চোখ সুড়সুড়িয়ে ঘুরছে ইতিউতি।

এসপ্ল্যানেডে এলেই তো হল না। জায়গা তো চিনতে হবে। নবদ্বীপ হালদার আর শ্যাম লাহার মত ঘুরপাক! শেষে ‘ওই দ্যাখ, ওই একটা দ্বার’- দ্বারে বাউন্সার, পেল্লায় হাতের গুলি। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই বুঝলুম এ ভূমি ক্ষত্রিয়ের, আমাদের নয়। চারধারে দাদাম দাদাম মিউজিক...লাল বেগনি আলো...গোল টেবিল...আর মঞ্চে মেনকা উর্বশী। বাঁই করে ইউটার্ন নিয়ে বাইরে। পরপর আরও দুটোয় একই গেরো। বাধ্য হয়ে বাউন্সারের শরণাগত। হাতের মাপ আর গোঁফের ভাঁজ দেখে সাঙাৎ রাষ্ট্রভাষায় বললে, ‘ইয়াহাঁ পর কোই শান্ত্ ম্যায়খানা হ্যাঁয় ক্যায়া ভাইসাব?’ বাউন্সার মুচকি হেসে বাংলায় বললে, ‘ এদিকটা দিয়ে যান। ডান হাতে দু নম্বর গলির তিননম্বর।

মানতে হবে, সহি ঠিকানা। শান্ত্ বলে শান্ত্। একেবারে নিরালা দি গ্রেট। সব কিছু ইশারায়। দেয়ালের টিভিগুলো বোবা। জ্যোৎস্নার মত টিমটিমে আলো। ফিসফিস করে আমি আর সাঙাৎ এদিক ওদিকে গপ্প জুড়লুম। কেমন একলা একটা ঘর এটা। সব একলা একলা লোকজন। বোধ হয় সব ঘেয়ো পুরুষ। জম্পেশ ঘা খেয়ে চুপ মেরে গেছে- ‘হামকো উনসে বফা কী হ্যাঁয় উম্মীদ/ যো নহীঁ জানতে বফা ক্যায়া হ্যাঁয়’। বেশ অনেকক্ষণ কাটলো সেদিন। মেজাজ হি মেজাজ! বাড়ি ফিরে গোটা একটা কবিতাও লিখে ফেলেছিলাম ঃ

                                    গৃহপালিত মেঘ গজল শোনায়
                                    অথচ ডানা মেলে গাংচিল

                                    পানশালায় ঝরে কুচোনো তুষার, গেলাসে জ্যোৎস্না জাম
                                    পান করে অতৃপ্ত রাত

                                    রাত্রিকে কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়ালে কি তুমি?
                                    অথবা রেশম কীট- যাপন কবিতা?

                                    ও ঢুলুঢুলু রাত, চোখ বুজে দেখ-
                                    কেমন শুঁয়োপোকা খেলে তিতলির পাখায় পাখায়...

কিন্তু সে সব তো অন্য শেয়ালের গল্প। এবার তো পুরো গল্পটাই আলাদা হবে। যা থাকে কপালে, হাজির হলুম পাঁচটার সময় অফিস গেটে। বসের গাড়ি এসে গপ করে গিলে নিল। নীল জিন্সে টপ টু বটম শোভিত বাণিজ়্যপতি শালাবাবুকে দেখলাম। শুনেছি ইনি নাকি বিজনেসের পাশাপাশি নিয়মিত সংস্কৃতির পিঠ চাপড়ান। বহু পাহাড় পর্বতের সাথে নাকি দহরম মহরম।

গাড়ি গড়াল সম্ভ্রান্ত হোটেলে। আর্দালি দরজা খুলে দিল। গুটিগুটি ঢুকলুম হোটেলের অ্যানেক্স বিল্ডিংএ। মিহি চাঁদ উড়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। মেঝেতে বুঝি পিছলে যাব। আরও আড়ষ্ট হলুম। বস বললে, ‘ পদ, ফিল ফ্রি!’ শালা ধুয়ো তুললে, ‘ফিল ফ্রি, ম্যান’!

অনেকদিন আগে একটা বইয়ে পড়েছিলাম। সৈয়দ মুজতবা আলির কথা। তিনি বলেছিলেন এক ছোট ছেলেকে নামতা শেখানোর প্রয়াসের কথা। বেশি চাপাচাপি করায় সে ছেলে নাকি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে শুরু করেছিলঃ একং, দশং, শতং, সহস্রং, লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাগ, ছেলে, পিলে, জ্বর, সর্দি, কাশী, প্রয়াগ, ব্ররন্দাবন, হরিদ্বার, পুরী, কচুরী, শিঙাড়া, পানতোয়া, রসগোল্লা, রসমালাই, প্রাণহরা, জলভরা, চমচম...এই লাইনেই তার গাড়ি চলে এরপর। আর বেলাইন নয়। অর্থাৎ কি না ওটিই তার পছন্দের বিষয়। এখানে আসার পর থেকে যা চলছে তাতে বেশ বুঝতে পারছি শালাবাবুটি ঠিক ওইরকমই একটি লাইন পাকড়েছেন। আর সে লাইনের উপাদান আমি। যে কোনও বিষয় থেকে ধূর্ত শেয়ালের মত টার্ন নিচ্ছেন আমার দিকে। তা খিল্লি করবি কর। ও আমার গা সওয়া। নেহাত বসের শালা, নইলে দু চারটে নমুনা আমিও ঠিক দেখিয়েই দিতুম।

ক্রমাগত মস্করায় ভাসতে ভাসতে শালাবাবুর পেয়ালা ছুটল। বসেরও। ওদের চোখ দেখে বুঝলুম, রাশের দায় আমারই। তাই হাতে পেয়ালা নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট সিপ দিলুম। পেয়ালাটা অসাধারণ! কাটা কাচে তরলের কত না রঙ রূপ! বস বললেন, ‘কী দেখছ, পদ?’ বললুম, ‘পেয়ালার রঙ’। বস হাসি হাসি মুখে ভুরু উপরে টেনে বললেন,
“গর্দিশ-এ সাগর্-এ জল্ বহ-এ রঙ্গীন তুঝ-সে
আঈন্হদারী-এ এক দীদহ্-এ হ্যায়রাঁ মুঝ-সে”
বোকার মত বললুম, ‘মানে?’

শালা বললেন, ‘এটা কাকে তুলে এনেছ, শালা গালীব জানে না, পেয়ালা ধরেছে!’

বললুম, ‘ গালীব জানি শালাবাবু, মীরও জানি। তবে কী জানেন, শায়রীর সাথে একটা আবেগ মিশে থাকে। যে বলছে তাকে বুঝিয়ে বলতে দিতে হয়। খামখা জানি জানি করতে নেই। রস নষ্ট হয়’
বস চেঁচিয়ে উঠল, ‘কেয়াবাৎ, কেয়াবাৎ পদ!’

শালা বলল, ‘শালা, ব্যাগে তেলের গূদাম এনেছ দেখি!’

উত্তর দিলুম না।

শালা হ্যাল্লাস করে আবার বলল, ‘এত প্রতিভা লুকিয়ে রাখ কোথায়?’
বললুম,              “ মানুষের বুকের ভিতর অনেক অলিখিত
                        চিঠি পড়ে আছে- .....
                        ……………………………
                        ……………………………সেই
                        সমুদ্রে- বহু ঝড় তুফান, মাছের সাঁতার
                        সেই মাটিতে- বহু খনিজ, জীবাণু, ফসলের ভ্রূণ
                        সেই অরণ্যের ভিতর অনেক বৃক্ষ, গুল্ম, ফুল, ফল, পাখি
                        আর দাবানল পড়ে আছে

                        মানুষ তাকে কখনও পাঠ করেনি!”

‘ সাবাস পদ! মনের কথাগুলো বলে দিলে’

বস আর কোনও কথা  না বলে পেয়ালায় মন দিলেন।

শালা বলল, ‘ তুমি পুনর্জন্ম বিশ্বাস কর?’

বুঝলুম নেশা সপ্তমে। নইলে হঠাৎ পুনর্জন্ম! কিছু বললুম না। ফের বলল, “ কী হল! ফুস! গপ্প খতম! কার দুলাইন কবিতা আওড়াচ্ছো, অথছ তত্ত্ব টত্ত্ব কিছুই পড়ো না, জানো না। সব এম্পটি বোউল!’

 ‘করি’

‘ কেন? কেন বিশ্বাস কর? তোমার ঠাকুদ্দা বিশ্বাস করতো বলে? একটাও প্রমাণ দিতে পারবে?’

‘ অভেদানন্দর বইতে তো আছে। স্বামীজী বলছেন...’

‘ হ্যাং...’

কান জ্বলছে। আর কী কী বলছে শালা, কানে ঢুকছে না। ওয়েটারকে ডেকে আরেকটা লার্জ নিয়ে গলায় ঢেলে দিলুম। বললাম, ‘বস! বাড়ি যাব’

বস তড়াক করে উঠে পড়লেন। গাড়ি গড়াল। শালাবাবু তখনও আমার তুষ্টি করছে।

বন্ধ জানালার বাইরে রাত বারোটার কলকাতা। বৃষ্টি ঝরছে। আলো মেখে নেমে আসছে অবিশ্রান্ত জল। বস বিড়বিড় করছেন, “ নেশা করে সুখ পেতে চায় কোন মুখপোড়া? আমি চাই কেবল রাতদিন নিজেকে একটুখানি ভুলে থাকতে”

কীসের দহন এত বসের? এত একা কেন? বস তখনও বিড়বিড় করছেন,
                        “ নহ্ হ্যায়রৎ চশ্ম্-এ সাকী-কী
                         নহ্ সোহবৎ দওর-এ সাগর-কী
                         মেরী মহফিল- মেঁ, গালিব,
                         গরদিশ-এ আফলাক বাকী হ্যায়”

শালাবাবু হ্যা হ্যা করে বলছেন, ‘ফ্রাস্টু খাওয়া লোক সব!’

চোখ দুটো জ্বলছে। তরলের জাদু কাজ করছে বোধ হয়। নইলে মিনমিনে মকরন্দ আমার গলায় এত জোর কোত্থেকে! ‘এই, গাড়ি চালাও!’ ড্রাইভার অবাক! ঠোনা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ কী হল! গাড়ি থামাও!’খ্যাঁচ করে ব্রেক চাপল। সটান নেমে এলাম দরজা খুলে। বামপাশে গড়ের মাঠ একা ভিজছে। আলোর রেখায় নেমে আসছে কুচোনো বরফ। এর চেয়ে বড় পানশালা আর কোথায়? দুটো হাত ছড়িয়ে বৃষ্টির স্নেহ মাখছি সারা শরীরে! জ্বালা বাড়ছে, না জুড়োচ্ছে বুঝছি না। লাইনগুলো পরপর ঠোঁটে উঠে আসছেঃ

                        “এই চলতে চলতে আমি দেখছি
                        কীভাবে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে বন্ধুদের মুখ
                        শহর ভরে উঠছে অবয়বহীন দেহে
                        আলাদা করে আর চেনা যাচ্ছে না আর কাউকেই
                        কীভাবে একটা বয়স অতিক্রম করে যাচ্ছে আর একটা বয়সকে
                        কীভাবে বদলে যাচ্ছে কৈশোর আর শৈশবের তারল্য...
                        .........................................................................
                        ........................................................................
                        অসহায়ের মতন দৌড়তে দৌড়তে দেখছি
                        কীভাবে একসময়ে আমি পার হয়ে যাচ্ছি সেই গাছটাকেও
                        এই দৌড়তে দৌড়তেই আমি বুঝতে পারছি
                        মানুষ কেন গাছ হয়ে উঠতে কখনও পারে না”

গাড়ির ভিতর বস শালাকে বলছেন, ‘ দেখছ তো, পুনর্জন্ম কেমন করে হয়’।।




                                           ঋণঃ কিশোর ঘোষ, প্রবাল কুমার বসু

Comments

Popular posts from this blog

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যাচ্ছেন কি? যাচ্ছেন কোথায়? লাখ টাকার প্রশ্ন! বিজ্ঞানের এক উত্তর, শিশু ভোলানাথের এক উত্তর, গোঁয়ার গোবিন্দর এক উত্তর, বোদ্ধার এক উত্তর! ঘন রহস্য! অথবা কোনোই রহস্য নেই। কৃষ্ণ কেমন, না যার মন যেমন। জলে হাওয়ায় গেলাস ভরা ভাবলে ভরা, আধখানা খালি ভাবলে খালি। আসল কথাটা হলো আজ বছরের শেষ সন্ধ্যে। আজ হেব্বি সেলিব্রেশন! কোথাও জামাল কুদু, কোথাও লুটপুট গয়া তো   কোথাও দিন হ্যায় সানি সানি সানি-   চারপাশ থেকে নানা রকমের গান ভেসে আসছে। একের সুরে আরেক চেপে বসায় কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না মনে। এমনটাও ভালো। এতেও এক ধরণের নির্লিপ্তি আসে। নির্লিপ্তিই তো মুখ্য, নির্লিপ্তিই মোক্ষ। আজ ভর দুপুরে ছাদে গিয়ে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছপালাগুলোর একটু পরিচর্যা করলাম। খালি দুটো টবে দুটো বীজ পুঁতলাম। একটা উচ্ছের  আর একটা ঢেঁড়সের । এই দুটোই আসলে আজকের বর্ষ শেষের আমি। কাজের দুনিয়ায় যেমন তেঁতো, ঘরের দুনিয়ায় তেমনি ঢেঁড়স। তো দুই আমিকে বছর শেষে দিলাম পুঁতে। নতুন ভোরে খোলস ছেড়ে বেরি

অসুস্থ সমাজ, অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং নিছক সাধারণী আবেদন

  ডাক্তারদের অনশন আজ ১০ দিনে পড়ল । পাঁচই অক্টোবর থেকে আমরণ অনশনে বসেছেন। প্রথমে ছ'জন পরে আরো একজন , উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে আরও দু'জন জুনিয়র ডাক্তার আমরণ অনশনে বসেছেন। বলছি বটে জুনিয়র, কিন্তু যে পর্যায়ের পরিণত মনোভাব এঁরা দেখিয়েছেন এবং দেখাচ্ছেন চিকিৎসা পরিভাষায় যাই হোক, মানবতার পরিভাষায় এরা সিনিয়রস্য সিনিয়র।  অনশন। কেবল জল। আর কিছু নয় । বলাই সহজ, কাজে মোটেই সহজ নয়। একবার রাগ করে না খেয়ে একবেলা ছিলাম। আর মনে পড়ে আর একবার মায়ের সাথে উপোস করেছিলাম কোজাগরি পূর্ণিমায়। দুবারই সন্ধ্যে হতে না হতেই হাটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগেছিল। আর টানা 10 দিন অভুক্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা! এখনো চলছে তাঁদের অনশন ব্রত।  শারীরিক সমস্যা জয় করতে হচ্ছে। জনমানসের আশা প্রত্যাশার পাহাড় জয় করতে হচ্ছে। মানসিক চাপ জয় করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের চাপ। সহজ কথা তো নয়। তাও জয় করতে হচ্ছে। অকথা কুকথাকে খড়কুটোর মত ছুঁড়ে ফেলে পাখির চোখে চোখ রাখতে হচ্ছে। কেন করছেন তারা অনশন? রাজ্যে গত নয়-ই অগস্ট নারকীয় ঘটনা ঘটে গেছে আর জি কর মেডিকেল কলেজে। তাদেরই সহকর্মী দিদি অথবা বোনের নৃশংস পরিণতি তাঁদের মুঠো শক্ত করেছে। চ

এসো মা, এসো মা উমা

 শাশ্বত কর সুপ্তপর্ব “যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে! গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!” ঠাকুর দালানে ধুনুচি সাজানো হচ্ছে। এও এক শিল্প! নারকেলের ছোবড়া উল্টো করে এমন করে সাজা হবে যে ধুনুচি নিম্নমুখী হলেও সহজে পড়বে না! নইলে আরতি জমবে কেমন করে!  ছোবড়া চুঁইয়ে ধোঁয়া মিশছে বাতাসে। বাতাসে ধুনোর গন্ধ! বাতাসে কর্পুরের গন্ধ! বাতাসে শিউলি, ছাতিম, বাতাবি ফুলের গন্ধ! বাতাসে ঠান্ডা আদর! আদর আমার গালে। মায়া আদর, আচ্ছন্ন আদর। যে সুগন্ধী বাতাস নাকি গোলাপের মৃদু পাঁপড়ি এই আদর এঁকে গেল, এই তো খানিক আগে যখন তেতলার চক বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচে ঠাকুরদালানের পাশে রাঙাপিসিমাদের আড্ডা দেখছিলাম, তার নাম এখানে লেখার কীই বা দরকার? গতকাল সকালে পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা সেই আমায় দিয়েছে, ভিড়ের অছিলায় আঙুল ছুঁয়ে গেছে। কাছে আসলেই মায়ের পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা আমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক পুব বাগানের বাঁধানো বেদির পাশে রাত আলো করে থাকা নিশিপদ্মের মতো! এ গন্ধের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা! এখন যেমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি চক বারান্দায়। হাতে শ্রীশঙ্খ! ঠাকুর তোরঙ্গ থেকে বড় শাঁখখানা আনতে পাঠিয়েছিলেন র