Skip to main content

তিনটে চারটে সাতটা আটটা হামি



তিনটে চারটে সাতটা আটটা হামি
শাশ্বত কর




“লেখার কথা মাথায় যদি জোটে
তখন আমি লিখতে পারি হয়তো
কঠিন লেখা নয়কো কঠিন মোটে
যা তা লেখা মোটেই সহজ নয়তো”

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কথা! যাঁরা শিল্প সাহিত্য চর্চা করে থাকেন, তাঁরা হাড়ে হাড়ে জানেন এর সত্যতা। সহজ কথা সহজ করে দেখাতে পারাটা একটা দক্ষতা। শ্রম লব্ধ, চর্চা অর্জিত দক্ষতা। যদি ভাঁজ দিলে না তানে, তবে আর শিল্পী সত্তা কোথায় প্রকাশ পেল? যা হচ্ছে তা সরাসরি টকাস টকাস বলে দেব, তাতে আর আমার ক্যালমাটা কোথায়? আর এই ক্যালমা যে গুরু কী বিষম বস্তু, সে তো আধুনিক কবি থেকে মোটর সাইকেলের উঠতি স্টান্টম্যান- সকলেই জানেন!

যাই হোক, নিজেও না ভাঁজ না ভেজে সোজা টপিকে আসি। কথা হচ্ছে, ‘হামি’ দেখে এলুম। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াঃ বস! নিজেকে দেখে এলুম। দেখার বেশ খানিক্ষণ পরে ভাবন এবং জাবর কাটন লব্ধ প্রতিক্রিয়াঃ নিজেদের দেখে এলুম।

সহজ কথাকেই যে কেবল সহজ করে বলতে পেরেছেন এই ডিরেক্টর ড্যুও তা কিন্তু নয়, কঠিন কথা গুলোকেও বেশ সহজে বলে দিয়েছেন। বিন্দুমাত্র আঁতলামোর আশ্রয় ছাড়া।

প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, বছর দেড়েক আগে ‘একদিন’ কাগজের জন্যে একটা লেখা লিখেছিলাম। ‘ভূত বসেছে শিয়রে’। ছেলেমেয়েদের ভালো করবার, টপার করবার চিন্তা আর মোবাইল লব্ধ ভার্চুয়াল সোশ্যাল মিডিয়ায় আচ্ছন্নতা এবং স্ট্যাটাস নামক খট্টাঙ্গ পুরাণের ভার বহনে, এবং- তা ছাড়া- ইত্যাদি- প্রভৃতি বিভিন্ন জালা ভরা জ্বালা যন্ত্রণায় জেরবার অভিভাবক আর শিক্ষক, সেই সঙ্গে শিক্ষা নামক মহাভার নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ খানিক একটা লেখা। যা হোক, সে লেখা বেশ কিছু মানুষের কাছে গৃহিত হয়েছিল এমন কথা শুনেছিলুম। সম্পাদক মশাইয়েরও পিঠ থাবড়ানি পেয়েছিলুম। অবিশ্যি 'সেটা কোনো বড় কথা নয়'

আসল কথাটা হল, নন্দিতা এবং শিবপ্রসাদ সেই কথাগুলো ফের মনে করালেন। আরো পরিষ্কার করে বলি, অনেক সাবলীল ভাবে মগজে ঢুকিয়ে দিলেন। একটা অদ্ভুত ক্ষমতা এই দু’জনের খুব সহজে এই আমাদের মত অতি সাধারণ মানুষদের চাওয়া পাওয়া ভাবনা চিন্তার কম্পাঙ্কটা ছুঁয়ে ফেলেন। আর কম্পাঙ্কে কম্পাঙ্কে মিলে গেলে যা হয়! অনুরণণ! ব্যস ছবি হিট! হতেই হবে। যে ছবি সাধারণ ভাবে আধারণ মানুষের কথা বলে, মানুষ তো তা দেখবেনই।

কথা হচ্ছে, দেখবেন তো বটে, ছবির বার্তাটুকু নেবেন কি? কথা হচ্ছে, সবাই হয় তো নেবেন না, কেউ কেউ তো তবু নেবেন! নতুবা নাই নিলেন কেউ, তাতেই বা আটকাচ্ছে কোথায়? নিজের সমাজ চিন্তাটুকু তো বলে দেয়া গেল!

অ্যাঁ! এইটেই হলো আসল কতা! সমাজ চিন্তা। এই পরিচালকদ্বয়ের একটা সাবেকি, সনাতন , পরিচ্ছন্ন সমাজ চিন্তা আছে। প্রায় সব ছবিতেই সমস্যা উত্থাপন আর সমস্যা সমাধানের ছুতোয় সেই চিন্তাটুকু বেশ প্রকাশিত হয়। হয় তো সেই সমস্যাগুলো খুব চেনা আর কল্পিত সমাধানটাও সহজ অনুমেয়, হোক না, তাতে ক্ষতিটা কোথায়? জটিল সামাজিক সমস্যাগুলোকে নরম করে দেখানোরও তো দরকার!

আমি বস অতি সাধারণ মানুষ। তরুণ মজুমদারের, তপন সিনহার ছবি দেখে বড় হয়েচি। এমন কী চুমকি চৌধুরীর ছবিতে বাঁ হাতের ক্যালি দেখিয়ে রঞ্জিত মল্লিকের দেয়া ডায়ালগও প্রায় মুখস্থ! কাজেই সিনেমা দেখতে গিয়ে টেকনিক্যাল ব্যাপার স্যাপার দেখতেই জানি না! সে পোকা বাছার কাজ যারা পারেন তারা করুন। আর পাঁচটা সাধারণ দর্শকের মতই আমারও সিনেমায় গপ্প চাই, সুন্দর গান চাই, হাসি কান্না হিরা পান্না আবেগ চাই, ফাটানো ন্যাচারাল অভিনয় চাই। সেখানে এই সব কিছুর সাথে অত্যন্ত সময় উপযোগী সমাজ চিন্তার অদ্ভুত মিশেল ঘটান নন্দিতা-শিবপ্রসাদ! ভালো তো লাগবেই!

যাক ছালা গুটোই! বন্ধুত্ব সংক্রান্ত চেনা গল্প জানা ছকের এই সুন্দর এবং অব্যর্থ প্রেজেন্টেশানে অনিন্দ্য চ্যাটার্জীর কথা এবং মন ভরানো সুরের গলা খুলে প্রশংসা করি। তনুশ্রী শঙ্কর, অপরাজিতা আঢ্য, কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, চূর্ণী গাঙ্গুলী, খরাজ মুখার্জী, গার্গী রায়চৌধুরী অথবা সুজন মুখার্জী কিংবা শিবপ্রসাদ স্বয়ং- এঁদের পরিণত অভিনয়ের পাশাপাশি ব্রত ব্যানার্জী (ভুটু ভাইজান), তিয়াসা পাল(চিনি) সহ সব ক্ষুদেদের সুপার ডুপার অভিনয়ের জন্য দু হাত তুলে ভালো লাগা জানাই। আর চাচাজান! আপনি বস চোখে জল এনে দিলেন! আপনাকে দেখলেই মনে হচ্ছিল, পিঠে একবার হাত রেখে বলি, ‘বস কর পাগলে! রুলায়েগা কেয়া!’

এবার কথা শেষ করি। রিভিউ লিখতে বসিনি। স্বতঃস্ফুর্ত, স্বপ্রণোদিত প্রতিক্রিয়া লিখতে বসেছি। কাজেই বস দায় নেই ছবির গপ্পটা বলে দেওয়ার। এটুকুই বলি, নন্দিতা দেবী খুব ভালো গপ্প বলেন। সে তো আপনারা আগেও দেখেছেন। এবারও দেখে আসুন। শত প্রতিশত নিশ্চিত, ভালো লাগবেই।

অবশেষে শেষ করবার আগে ভুটু ভাইজানের দেখানো পথেই সকল সুস্থতাকামী মানুষের লেগে মিষ্টি, পবিত্র, ননপ্যাশনেট হামি হামি হামি- ছ শো ছেষট্টিটা হামি জানিয়ে শেষ করলুম।


                                                                                 ..................... শাশ্বত কর, ২১শে জুন, ২০১৮

Comments

Popular posts from this blog

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যাচ্ছেন কি? যাচ্ছেন কোথায়? লাখ টাকার প্রশ্ন! বিজ্ঞানের এক উত্তর, শিশু ভোলানাথের এক উত্তর, গোঁয়ার গোবিন্দর এক উত্তর, বোদ্ধার এক উত্তর! ঘন রহস্য! অথবা কোনোই রহস্য নেই। কৃষ্ণ কেমন, না যার মন যেমন। জলে হাওয়ায় গেলাস ভরা ভাবলে ভরা, আধখানা খালি ভাবলে খালি। আসল কথাটা হলো আজ বছরের শেষ সন্ধ্যে। আজ হেব্বি সেলিব্রেশন! কোথাও জামাল কুদু, কোথাও লুটপুট গয়া তো   কোথাও দিন হ্যায় সানি সানি সানি-   চারপাশ থেকে নানা রকমের গান ভেসে আসছে। একের সুরে আরেক চেপে বসায় কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না মনে। এমনটাও ভালো। এতেও এক ধরণের নির্লিপ্তি আসে। নির্লিপ্তিই তো মুখ্য, নির্লিপ্তিই মোক্ষ। আজ ভর দুপুরে ছাদে গিয়ে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছপালাগুলোর একটু পরিচর্যা করলাম। খালি দুটো টবে দুটো বীজ পুঁতলাম। একটা উচ্ছের  আর একটা ঢেঁড়সের । এই দুটোই আসলে আজকের বর্ষ শেষের আমি। কাজের দুনিয়ায় যেমন তেঁতো, ঘরের দুনিয়ায় তেমনি ঢেঁড়স। তো দুই আমিকে বছর শেষে দিলাম পুঁতে। নতুন ভোরে খোলস ছেড়ে বেরি

অসুস্থ সমাজ, অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং নিছক সাধারণী আবেদন

  ডাক্তারদের অনশন আজ ১০ দিনে পড়ল । পাঁচই অক্টোবর থেকে আমরণ অনশনে বসেছেন। প্রথমে ছ'জন পরে আরো একজন , উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে আরও দু'জন জুনিয়র ডাক্তার আমরণ অনশনে বসেছেন। বলছি বটে জুনিয়র, কিন্তু যে পর্যায়ের পরিণত মনোভাব এঁরা দেখিয়েছেন এবং দেখাচ্ছেন চিকিৎসা পরিভাষায় যাই হোক, মানবতার পরিভাষায় এরা সিনিয়রস্য সিনিয়র।  অনশন। কেবল জল। আর কিছু নয় । বলাই সহজ, কাজে মোটেই সহজ নয়। একবার রাগ করে না খেয়ে একবেলা ছিলাম। আর মনে পড়ে আর একবার মায়ের সাথে উপোস করেছিলাম কোজাগরি পূর্ণিমায়। দুবারই সন্ধ্যে হতে না হতেই হাটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগেছিল। আর টানা 10 দিন অভুক্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা! এখনো চলছে তাঁদের অনশন ব্রত।  শারীরিক সমস্যা জয় করতে হচ্ছে। জনমানসের আশা প্রত্যাশার পাহাড় জয় করতে হচ্ছে। মানসিক চাপ জয় করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের চাপ। সহজ কথা তো নয়। তাও জয় করতে হচ্ছে। অকথা কুকথাকে খড়কুটোর মত ছুঁড়ে ফেলে পাখির চোখে চোখ রাখতে হচ্ছে। কেন করছেন তারা অনশন? রাজ্যে গত নয়-ই অগস্ট নারকীয় ঘটনা ঘটে গেছে আর জি কর মেডিকেল কলেজে। তাদেরই সহকর্মী দিদি অথবা বোনের নৃশংস পরিণতি তাঁদের মুঠো শক্ত করেছে। চ

এসো মা, এসো মা উমা

 শাশ্বত কর সুপ্তপর্ব “যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে! গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!” ঠাকুর দালানে ধুনুচি সাজানো হচ্ছে। এও এক শিল্প! নারকেলের ছোবড়া উল্টো করে এমন করে সাজা হবে যে ধুনুচি নিম্নমুখী হলেও সহজে পড়বে না! নইলে আরতি জমবে কেমন করে!  ছোবড়া চুঁইয়ে ধোঁয়া মিশছে বাতাসে। বাতাসে ধুনোর গন্ধ! বাতাসে কর্পুরের গন্ধ! বাতাসে শিউলি, ছাতিম, বাতাবি ফুলের গন্ধ! বাতাসে ঠান্ডা আদর! আদর আমার গালে। মায়া আদর, আচ্ছন্ন আদর। যে সুগন্ধী বাতাস নাকি গোলাপের মৃদু পাঁপড়ি এই আদর এঁকে গেল, এই তো খানিক আগে যখন তেতলার চক বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচে ঠাকুরদালানের পাশে রাঙাপিসিমাদের আড্ডা দেখছিলাম, তার নাম এখানে লেখার কীই বা দরকার? গতকাল সকালে পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা সেই আমায় দিয়েছে, ভিড়ের অছিলায় আঙুল ছুঁয়ে গেছে। কাছে আসলেই মায়ের পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা আমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক পুব বাগানের বাঁধানো বেদির পাশে রাত আলো করে থাকা নিশিপদ্মের মতো! এ গন্ধের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা! এখন যেমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি চক বারান্দায়। হাতে শ্রীশঙ্খ! ঠাকুর তোরঙ্গ থেকে বড় শাঁখখানা আনতে পাঠিয়েছিলেন র