শাশ্বত কর
বিতানের চিহ্ন পড়ছিলাম। মনের মাঝে একটাই
ভালোবাসার সুর গুনগুন করে গেল। মৃণাল সেনের সেই অবিস্মরণীয় ছবি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের
সেই মায়াময় গান। “নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী আর পৃথিবীর পরে ওই নীলাকাশ- তুমি দেখেছ
কি?”
দেখে তো সবাই। সবাই কি আর সেই সাধারণ
দেখাকে বলতে পারে? সাধারণ দেখায় অসাধারণত্ব খুঁজে পাওয়ার চোখ তো বড় বেশি নয়। সেক্ষেত্রে
যশোলাভ তো অনেকটাই শ্রমসাধ্য, এমন কি দুঃসাধ্যও হতে পারে। তার চেয়ে চেনা খাতে গপ্প
না বইয়ে মন যে দিকে ভাসতে চায় সেই কল্পখাতে ডিঙা ভাসানোই তো নিশ্চিন্তির পথ! বিতান
অবশ্য সেই পথটায় হাঁটেননি।
বরং ‘রাতের সে নীরবতা’ অথবা ‘মানুষের
অশ্রু শিশিরে শিশিরে ঝরে’ কেমন করে তা দেখে গেছেন। চেষ্টা করেছেন নিরপেক্ষ ভাবে সেই
দৃশ্যরাজির দলিল পেশ করবার।
সাতটা গল্পের মালা। একই ফুলের মালা।
কেবল ভিন্ন ভিন্ন গাছে ফোটা নাম না জানা ফুল। নিয়ম মেনে ফোটে। নিয়ম মেনে বংশ বাড়ায়।
নিয়ম মেনে ঝরে যায়। হাসি কান্না রাগ দুঃখ- মানুষের স্বাভাবিক গুণে গুণান্বিত মানুষের
গল্পমালা। বড়াই নেই, বাড়তি নেই, যা ঘটার তাই ঘটছে। খুব স্বাভাবিক ভাবে ঘটছে। এমন ঘটনা
যাতে পৃথিবীর ঘূর্ণণের কিছু পরিবর্তন হয় না! ঘাসের সবুজ আর আকাশের নীলের মতই খুব স্বাভাবিক
কিছু ঘটনা।
একই জায়গার বাসিন্দা অথবা একই ইশকুলের
পড়ুয়া বলে গল্পগুলো আরো চেনা আমার। রতনদার চায়ের দোকান আর তার ডুমো আলুর দমের ট্যালটেলে
ঝোলের লোভ পেরিয়ে আসতে হয়েছে আমাকেও। ‘তিনটে কয়েন’ এর বিট্টুকেতো তাই আমি চিনি। ওই
আলুর লোভে তো আমার বন্ধুদেরও দেখেছি কেমন করে মন্দিরে ছিটিয়ে থাকা কয়েন প্রণামের ছলে
হাতড়ে নেয়। এক টাকা থেকে মাত্র দশ নয়া কম থাকায় পকোড়ার দোকান থেকে মুখ লুকিয়ে আসার
দুঃখ তো আজও তাজা! কিন্তু ওই যে বললাম, এ সবই ছোটো ছোটো দুঃখ! কে রাখে খবর তার?
অবশ্য ছোটোগল্পের সংজ্ঞায় হাঁটলে ছোটোগল্পেরই
সে হিসাব রাখার কথা। ছোটোগল্প তা রাখেও। বলা যায় সেই বৃহৎ বিস্তারেই নবীনতম সংযোজন
বিতানের ‘চিহ্ন’!
চিহ্ন কে না রাখতে চায়? এলি যখন ভবে
দাগ রেখে যা তবে! এই দাগ রাখার মোহই তো সবের মূলে। এ মোহমুক্ত হবার হাজারো পথ বাতলানো
থাকলেও সুকঠিন সেই পথে হাঁটা অসাধারণেরও কম্ম নয়। অনন্য সাধারণ সাধক হাঁটেন সেই পথে।
ছোটো বড়ো সব মানুষেরই তো মন একই। চাওয়া পাওয়ার ভার আলাদা হলেও ব্যক্তির নিরিখে তার
গুরুত্ব তো সমান। চিহ্ন রাখার চেষ্টাতেই প্রাপ্তি আনন্দ, অপ্রাপ্তির বিষাদ। সাধারণের
সেই ছাপ রাখার গল্পকথাও অবধারিতভাবে উঠে এসেছে বিতানের কথায়। ‘লালির হাতটা হারিয়ে’
গেলেও কাহিনিকারের দেখাটুকু হারিয়ে যায় নি, বরং নির্লিপ্ততার আদলে পাঠকের মনে চিহ্ন
আঁকার প্রচ্ছন্ন প্রয়াস করে গেছেন লেখক।
যদিও বিতান আমার অতি প্রিয়জন, তবু নিরপেক্ষ
ভাবে বলি, ‘চিহ্ন’ সত্যিই সাধরণের অসাধারণ ছবি। আর বইয়ের প্রচ্ছদটিও অক্ষরযাত্রার সাথে
বড়ই মানানসই। অসামান্য প্রচ্ছদ করেছেন গুণী মানুষ সৌরীশ মিত্র। শাম্ভবী ইমপ্রিন্টের
যত্নের ছাপ ‘চিহ্ন’র সারা গায়ে।
চিহ্ন
লেখকঃ বিতান চক্রবর্তী
প্রকাশকঃ শাম্ভবী
প্রকাশকালঃ ২০১৮ বইমেলা
Comments
Post a Comment