মর্দকো দর্দ হোগা ^হোনা চাহিয়ে
শা শ্ব
ত ক র
ছবিটা দেখতে দেখতে বারবার ক্যাচ লাইনটা বদলে দিতে ইচ্ছে করছিল। পরিচালকের ডেবিউ ফিল্ম ‘আবা’ আমার দেখা হয় নি। এবার দেখব। সঠিক ভাবে বললে অমর কৌশিকের গল্প বলার ধরণ আর পরিচালনার নিপুণতা দেখতে বাধ্য করবে।
বিষয়টা বলা যায় পুরোনোই,
বলবার আঙ্গিকটি আকর্ষণীয়, ঈর্ষনীয়ও বটে।
আমার মত আম জনগণেশ বরাবরই
ভূতপ্রেমী। আর দেশি ভূতিয়া ছবি মানেই ভাবুন কী ছিল! ছিল হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ মার্কা পেত্নি
হাসি অথবা হুহুহাহা মার্কা অট্টহাসি, ঝ্যাং ঝ্যাং ঝ্যাং ঝ্যাং মার্কা আবহ,
মুখোসধারীর ভূত নেত্য, আর স্বল্পবাসী নায়িকার ঝিঙ্কুমিঙ্কু গান অথবা ঝিরঝির ঝর ঝর স্নান!
দিন বদলালে রুচি বদলায়। ঝিঙ্কু গানের জন্য আর ভূতিয়া ছবির দরকার হয় না। তবুও নতুন
ভয়ের ছবিগুলোয় ইদানিং ভি এফ ক্স, টি এফ ক্স এফেক্ট টেফেক্ট ঝুলিয়ে গা ছমছমে এবং
উত্তেজনার পাঁচফোড়নে যা হোক একটা কিছু দাঁড়াত! তাই আমরা দেখতুম। কিন্তু এই ভদ্রলোক
আমাদের কী দেখালেন! ভয়ের মোড়কে একটা আদ্যন্ত সামাজিক বার্তা। এভাবেও তা হলে বলা
যায়!
নারীদের উপর অত্যাচার এখন
তো আর চমকে দেওয়ার মত খবর নয়। নিত্যদিন খবরের কাগজ খুললেই গা শিউরে দেওয়া, ভয় পাইয়ে
দেওয়া সব খবর! সেই নিয়ে আলোচনা, গোল টেবিল, দায় ঝাড়া, সুযোগ নেয়া, ফের অত্যাচার-
সব চলছে। স্কুলে, কলেজে, অফিস, কাচারি, বাজার ঘাট, ট্রেন বাস, অটো মায় দুর্গাপুজোর
ভিড়ে অবধি সবখানেই নিগ্রহ! শাস্তি কোথায়?
নির্বোধ, আত্মভোলা,
কামসর্বস্ব ‘মর্দ’ দাঁত নখ বার করে আছে সবখানে। ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে পারবেন না
নারী! অফিসে একা কাজ করতে পারবেন না নারী! বর বাইরে কাজে গেলে বাড়িতে একা, এমন কী
শ্বশুর বাড়িতেও, থাকতে পারবেন না নারী! শিশু থেকে বৃদ্ধা- কারোর রেয়াত নেই!
‘গল্প হলেও সত্যি’ মনে
পড়ছেঃ ‘ভার্চুয়ালি এ হলো স্ত্রী দেহতত্ত্বের যুগ!’
তাও তো সে কত বছর আগের
কথা! তারপর কত মেঘ উড়ে গেছে, কত বীজ আজ বৃক্ষ। আজ কলার ঊঁচিয়ে রমণী রঞ্জন ‘মর্দ’
এক জায়গায় হলো, তো কোন দেহতত্ব নিয়ে মশগুল হবে, সে আর লেখার প্রয়োজন থাকে না! নারী
প্রতারণা, অত্যাচার কলার উঁচিয়ে বলবার মত বিষয় বটে এখনও কোথাও কোথাও কোনো কোনো
বন্ধু মহলে।
সবই তো জানা দুঃখ চেনা
বকবক! কিন্তু কাজ হচ্ছে কোথায়?
আঙুল বাঁকিয়ে ঘি তোলার
কায়দা নতুবা ‘যদা যদা হি ধর্মস্য/ গ্লানির্ভবতি ভারত..’ যাই ভাবা যাক, সেই
কায়দাতেই ১৯৯০ এর দশকের কর্ণাটক অঞ্চলের ‘নালে বা’ মিথ মনে করিয়ে দিয়েছেন পরিচালক।
হয় কাঁপন ধরাতে চেয়েছেন ‘মর্দ’ এর ডোন্টকেয়ার বুকে নতুবা পৌরুষের দুর্বল ধারণায়
কুড়ুলের কোপ বসাতে চেয়েছেন পরিচালক অমর কৌশিক। ছবি শুরুর আগের বক্তব্যের সাথে তাই
সহমত। “কোনো অন্ধবিশ্বাসকে উসকে দেবার উদ্দেশ্য এ ছবির নয়”!
“ও স্ত্রী কাল আনা”(কন্নড়ে
নালে বা)! ছমছমে রাত্তিরে নির্জন পথে পথে ঘুরছেন এক ভয়ঙ্কর উড়ন্ত ডাকিনী! দরজায়
আঘাত করে মোহিনী সুরে ডাকছেন নাম ধরে, যেমন করে গ্রাম বাংলায় ডেকে যায় নিশি! সাড়া
দিলে কি শেষ! বাসিন্দাদের স্মার্ট আইডিয়াঃ দরজার বাইরে লাল অক্ষরে লেখা “ হে
স্ত্রী! তুমি কাল আইস!” ভিতরের ভাবনাটা ভাবুন, ঘরের ছাপোষা স্ত্রীএর মতই যেন এই
ডাকিনীও। হতেই যে হবে তাকে। আরে বাবা ভূত হও, পেত্নি হও, শাঁখচুন্নি, ডাকিনী,
প্রেতিনী যেই হও না রে বাবা, আদতে তো তুমি নারী! তোমাকে ঠকানো, বোকা বানানো, ভুল
বোঝানোর জন্যে কী লাগে আর? কাজেই ওই কটা কথা সেই ‘স্ত্রী’ পড়বেন আর বাড়ির বৌ, বোন,
মায়ের মত মুখ বুজে ভালো মানুষটি হয়ে চলে যাবেন! ভয় থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজাতেও
নারী সম্পর্কে কী মহান ভাবনা!
এই তো কাজ পরিচালকের। তিনি
সফল। হয় তো লোক টানতে ‘হরর কমেডি’ সূচক ব্র্যান্ড লাগাতে হয়, তবু শুরু থেকে শেষ
পর্যন্ত নারী সম্পর্কে, নারী পুরুষের সম্পর্ক সম্পর্কে তথাকথিত ‘মর্দ’দের ধারণা
বাসনা পুরোপুরি উন্মোচিত হয়ে যায়।
এমন সমাজ যেখানে লেডিস
টেলর কেবল চোখ ঘুরিয়ে মহিলার ভাইটাল স্ট্যাট স্যাটাস্যাট বলে দেন! সে নিয়ে কত
গর্বিত তার স্বজন, সুজন। ভেবে দেখুন, আপনার আমার কত বন্ধুর এমন অতি সাধারণ ক্ষমতা
ছিল বা আছে। কর্মক্ষেত্রে এখনও কত ‘এক্সরে’ নজর নারীকে দেখেই তার আদ্যোপান্ত
ঠিকুজি কুষ্ঠি এমন কী তার ভবিষ্যৎ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ পর্যন্ত করে ফেলতে
পারেন! তবে?
যাই হোক, আদি রসের ভুড়ভুড়ি
ওঠা সমাজে ভয় পাবার একটি মাত্র সময়। পূজোর চার দিন। বাড়ির দরজায় তখন নারীদের
তত্ত্বাবধানেই লেখা হচ্ছে, “ও স্ত্রী! কাল আ না!” এও তো আমাদের অতি পরিচিত ছবি।
নারীর অবমাননায় নারীর হাত খুব ছোট তো বোধ হয় নয়। ক’ জন পারেন স্নেহ, দায়ের বোধ
পেরিয়ে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে? যাঁরা পারেন তাদের সাষ্টাঙ্গ প্রণাম!
যা বলছিলাম, পূজোর ওই
সময়টাতেই আসেন স্ত্রী। মন্দিরে আসেন দেবী। রাস্তায় আসেন স্ত্রী। পরিচালক কিন্তু
একবারও সেই দেবীর আরতি আমাদের দেখান নি। বরং দেখিয়েছেন মন্দিরের বাইরের সেই
স্ত্রীকে। যিনি প্রাপ্য সম্মান আর মর্যাদার লড়াই লড়ছেন। যিনি মুহূর্তে ভ্যানিস করে
দিচ্ছেন বিকৃত কামের পূজারী ‘মর্দ’কে। বন্ধুত্বের নামে আদতে কামগন্ধ খুঁজে বেড়ানো ‘মর্দ’কে।
সে পুরুষ হারিয়ে যায়। পড়ে থাকে কেবল তার পোষাক, বহিরঙ্গ!
লম্বা লাইন হারিয়ে যাওয়া
পুরুষের। তরুণ থেকে প্রৌঢ়ের বেশ দীর্ঘ লাইন। তার মানে কী দাঁড়াল পাঠক? সে পুরুষ
অনায়াসে একলা হয়ে যেতে পারেন নির্জন রাস্তার অনাম্নী অচেনা নারীর ডাকে! আহা কী
পৌরুষ! বাঁচার জন্যে বাড়ির নারীদের সন্ধ্যার পর বের করে আগল দিয়ে ঘরে থাকে! আহা!
কতই না পৌরুষ! এমন কী স্ত্রী পোষাক চড়িয়ে বাইরে ঘুরতেও শেষ অবধি বাধা নেই! আহা! কী
শক্তিশালী পৌরুষ!
এই কপট পৌরুষের নড়বড়ে
মূলেই আঘাত স্ত্রীর। তীব্র আঘাত। পরিচালককে তাই কুর্নিশ।
আসি অভিনয়ের কথায়।
রাজকুমার রাও ধীরে ধীরে আমাদের সম্পদ হয়ে উঠছেন। ছবির মূল গল্প তো অনেকটা তাকে
ঘিরেই। হরর কমেডির কমেডির রাশ তো অনেকটাই তার হাতে। তা ছাড়া পঙ্কজ ত্রিপাঠি (রুদ্র),
অপরশক্তি খুরানা (বিট্টু), অভিষেক ব্যানার্জী (জনা) যোগ্য সঙ্গতকারী। বলা বাহুল্য
শ্রদ্ধা কাপুরও তার প্রয়োজনীয় চরিত্রে উজ্জ্বল। শচীন-জিগারের গান সমাজোপযোগী, মানে
যেমনটা হওয়া উচিত ছিল তেমনই। কেতন সোধার আবহ কিন্তু বেশ ভৌতিক, মাঝে মাঝেই বুকে
কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়।
ছালা গোটাই। ছবিটা থিয়েটারে
গিয়ে দেখার মত। কাজেই গপ্প পুরো বলে দিলাম না। গোটা ছবি জুড়ে আদতে স্ত্রী শক্তির
জয়গান গেয়েছেন অমর কৌশিক। কমেডি আর হরর তার প্রয়োজনীয় শস্ত্র এক্ষেত্রে। ‘স্ত্রী’
এর কার্যকলাপ থেকে শুরু করে তার থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সর্বত্র নারীকে তার
সামাজিক সম্ভ্রম দেয়ার বার্তা! শহরের রক্ষাকর্তাও যে ‘তওয়ায়েফ জাদা’, এ প্রতিষ্ঠার
মধ্যেও সম্ভ্রমটুকু জিইয়ে রাখার মহৎ প্রয়াস বলেই বোধ হয়। যে ‘স্ত্রী’ শহরের ত্রাস,
তারই মূর্তি স্থাপন আর তার নীচে সুর বদলে ‘ও স্ত্রী রক্ষা করনা’ লেখার মধ্য দিয়েও
তো সেই লড়াই জেতারই সুগন্ধ!
একটা কথাই আবারও বলি, যে
যা ভাষা বোঝে তাকে সেই ভাষাতেই বলা দরকার। যে সমস্ত ‘অতি চালাক ডেয়ার ডেভিল মর্দ’ চেতন অথবা অবচেতনে নারীদের
হেয় করবার নানান স্বপ্নে অন্তঃকরণের ঘরদুয়ার সাজান, আইন অথবা প্রশাসন সব কিছুর
লঙ্ঘনেই যার পৌরুষ মর্যাদা পায়, তাদের জন্য এই ‘স্ত্রী’ই দরকার। এই ‘মর্দ’দের
জন্যে ‘ও স্ত্রী আনা জরুর!’
Comments
Post a Comment