শাশ্বত
কর
বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে।
লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যাচ্ছেন কি? যাচ্ছেন
কোথায়? লাখ টাকার প্রশ্ন! বিজ্ঞানের এক উত্তর, শিশু ভোলানাথের এক উত্তর, গোঁয়ার গোবিন্দর
এক উত্তর, বোদ্ধার এক উত্তর! ঘন রহস্য! অথবা কোনোই রহস্য নেই। কৃষ্ণ কেমন, না যার মন
যেমন। জলে হাওয়ায় গেলাস ভরা ভাবলে ভরা, আধখানা খালি ভাবলে খালি। আসল কথাটা হলো আজ বছরের
শেষ সন্ধ্যে। আজ হেব্বি সেলিব্রেশন! কোথাও জামাল কুদু, কোথাও লুটপুট গয়া তো কোথাও দিন হ্যায় সানি সানি সানি- চারপাশ থেকে নানা রকমের গান ভেসে আসছে। একের সুরে
আরেক চেপে বসায় কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না মনে। এমনটাও ভালো। এতেও
এক ধরণের নির্লিপ্তি আসে। নির্লিপ্তিই তো মুখ্য, নির্লিপ্তিই মোক্ষ।
আজ ভর দুপুরে ছাদে গিয়ে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছপালাগুলোর একটু পরিচর্যা করলাম। খালি দুটো টবে দুটো বীজ পুঁতলাম। একটা উচ্ছের আর একটা ঢেঁড়সের। এই দুটোই আসলে আজকের বর্ষ শেষের আমি। কাজের দুনিয়ায় যেমন তেঁতো, ঘরের দুনিয়ায় তেমনি ঢেঁড়স। তো দুই আমিকে বছর শেষে দিলাম পুঁতে। নতুন ভোরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে যদি। কচি অবস্থায় ছুঁচোর ছানাকেও মিষ্টি দেখায়। কাজেই সবুজ শাখে হলুদ ফুল না ফোটা অবধি উচ্ছে লতা অথবা ঢেঁড়সের গুল্ম দুটিই সুন্দর থাকবে। পুরোনো থেকে নতুন- খোলস বদলানো আর আশাবরী ছাড়া তো আর কিছুই না! ‘যাওয়া আসার এই যে খেলা চলছে হেথায় সর্বক্ষণ!’
আমার সাথে টুকাইও ছাদে গেছিল। আজ রোদ্দুরটাও
ছিল ভারী মিষ্টি। ভর দুপুর, অথচ চাঁদি জ্বালানো না, বরং বেশ আরামদায়ক। বনভোজনের আদর্শ।
মনে মনেই অবশ্য একথা বলেছি। নইলে বর্ষশেষের আদুরে আদিখ্যেতা মুহূর্তে গার্হস্থ্য গণ্ডগোলে
বদলে যেতে পারত। পরিচিতরা সবাই বেড়াতে গেছে, দেয়ালে দেয়ালে সে সমস্ত ছবি টাঙানো, সেখানে
মাঝদুপুরে ঘরের ছাতে বেড়াতে বেড়াতে হাতের চেটোয় বনভোজনের গন্ধ নেওয়া কজনের সহ্য হবে
বলুন তো?
কথায় ফিরি, বর্ষশেষের দুপুরে আমার এক ইচ্ছা
হলো। কুঁজোর চিৎ হয়ে শুতে ইচ্ছে করে, আমার উপুড় হয়ে শুতে ইচ্ছে হলো! গোটা গায়ে বর্ষশেষের
এই সূর্য মেখে নিতে ইচ্ছে হলো! ইচ্ছে চেপে রাখতে নেই- ঠাকুরের কথা। কাজেই মনে মনে দুগগা
বলে টুকাইয়ের শালখানা চেয়েই ফেললাম, বিতন্ডা ছাড়া দিয়েও দিল। সেইখানা ছাদে বিছিয়ে উদোম
গায়ে শুয়ে পড়লাম। জোহানেসবার্গে এভাবেই কেউ হয়তো সানবাথ নিচ্ছেন। আমি না হয় যতীনদাস
নগরে চারতলার ছাতে সূর্য মাখব। মন হো তো চাঙ্গা, তো কাটোরে মে গঙ্গা।
আকাশের নিচে না শুলে গোটা আকাশ দেখা যায় না।
বিশাল আকাশ ! অনন্তের বোধ না জাগুক, খানিক যেন আঁচ মেলে। খানিক আকাশ চাইতেই চোখে ঝিলমিল
লেগে গেল! অনন্ত দেখার চোখ কি আর সবার ! তা যা হোক প্রসাদ কণিকামাত্র পেলেও সৌভাগ্যের।
পিঠে রোদের ওম, চোখে রোদের ঝিল মিল- কাত হয়ে শুতেই নিচের তলার প্রতিবেশীর ঘরের কথাবার্তা
কানে এলো! আহা! ‘শীতল শীতল পরের কথা আসুক বন্ধু কানে!’ ব্যোমকেশ বক্সির কথা মনে পড়ে
যাচ্ছিল। এরকম ভাবেই একতলায় অনুকুলবাবুর বাক্যালাপ শুনেছিলেন ব্যোমকেশ। আমি ব্যোমে
আমার অবশিষ্ট কেশ সঁপে দিয়ে পড়ে রইলাম। চোখের সামনে ছবির মতো ভাসতে থাকল গোটা বছরের
নির্যাসচিত্রঃ
বর্ণময় বছর! ফুলে ফলে গন্ধে বর্ণে একেবারে
রঙিন বছর! কত দেখলাম, কত ঠেকলাম, ঠেকে কত শিখলাম, শিখে কত ঠেকলাম, ফের…পুরো চেইন রিঅ্যাকসন!
পাকা পোনার মতো ঘাঁই মেরে মেরে উঠল এক এক জন মানুষ! তাদের কত মুখ! কত রূপ! বিশ্বরূপ
দর্শন! পার্থ প্রার্থনা করছেন, ‘হে কৃষ্ণ! যে রূপ দেখে অভ্যস্ত সে রূপেই ফিরে এসো হে!’-
সে কি আর এমনি! অর্জুনের সহ্য হয়নি, আর আমি তো ছারপোকাস্য ছার! জেনাসের মত কারও দুটি
মুখ, কারো আবার চতুর্মুখ, কেউ বা দশানন। দশমুখে তারা আরও দশ জনের কথা কইছে। আবার তার
দশটি মুখের প্রতিটির কথা বুঝিয়ে যাচ্ছেন আরও দশ জন। শুনছি, বুঝছি, গিলছি না! গিলে করব
কী! না পারি কইতে! কইলেই যদি বন্ধু ব্যাজার হন! অতএব না কওয়ার কষ্ট না সইতে পেরে না
বোঝার ভেক ধরে নেই হয়ে থাকি!
ভেক- এইটেই অন্যতম সত্যি বলে বোধ হয়। এক,
এক আর এক। ভেকটি বদলে বদলে কেবল এক থেকে এক কোটি। পুরোনো বদলে নতুন। একটা গল্প বলি-
ডাকসাঁইটে সুন্দরী কাকিমা। কী তার আলগা চটক!
ফুলের পাশের ভোমরার মতোন গুণমুগ্ধরা ভনভন করে। বহুদিন দেখিনি তাকে, অন্য কোথায় বাড়ি
করে চলে গেছিলেন। আক্কেল দাঁতের যন্ত্রণা সইতে না পেরে ডাক্তারের কাছে গেছিলাম যেদিন,
সেদিন দেখি সেই কাকিমার মুখ হাঁ করিয়ে চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসা শেষে দেখলাম স্টিলের বাটিতে
ঠকাং করে একপাটি দাঁত নামল। ডাক্তার দাঁত ঘষলেন। কাকিমা নামলেন। আমি রুমালে মুখ মোছার
ভঙ্গী করে দেখলাম অমন ঢলঢলে মুখ দাঁত বিনে তুতলু পুতলু! সেই বাটির দাঁত যখন ফের পরা
হলো খানিকটা ফেরত এলেন। আক্কেল দাঁত আমার আক্কেলে কিলো কষাল! বলল, ভেক বদল আর বেশ বদল। পুরোনো হয়েছে এবার জামা বদলে
নাও। নতুন জামার আনন্দে শিশুর মতো ফের খিলখিলিয়ে ওঠো, ফের ওঠো, জাগো আর হেঁটে যাও!
হেঁটে যাওয়াই অনিবার্য। জামা বদলানোই অনিবার্য! নব নব রূপে হেসে ওঠো হে প্রাণ। বিজ্ঞান
বলেছেন, কিচ্ছুটী ধ্বংস হওয়ার জো নেই, তৈরি হওয়ার জো নেই। বস্তুতে শক্তিতে, পুরুষে
প্রকৃতিতে মিলে যতখানি ছিল তাই থাকবে। শুধু রূপ বদলাবে , বেশ বদলাবে আর নতুন উঠবে হেসে।
গীতাও বলেন,
“বাসাংসি জীর্ণানি
যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায়
জীর্ণা-
ন্যনানি সংযাতি নবানি
দেহী”
এ শরীর সব শরীর। সর্বভূতে ছড়িয়ে থাকা আত্মা।
নতুন বসনে তার নতুন লীলা। তার নতুন কোনো রূপ দেখছে তাঁকেই। জটিল ধাঁধা, অথচ সহজ উত্তর!
গীতার কথা বললাম বটে , কিন্তু উচিত হলো না।
গীতাকে এখন দর্শনের গণ্ডী ছাপিয়ে অন্ধত্ব ছড়ানোর হাতিয়ার করতে চলেছেন কেউ কেউ। নির্লিপ্তির
আকরকে ক্ষমতার বাঁধন দেওয়ার দড়ি করতে চাইছেন কেউ কেউ। ‘সম লোষ্টাশ্ম কাঞ্চন’- পাথর,
ছাই আর সোনায় সমজ্ঞান শেখানোর গ্রন্থটিকে কোষাগারের চাবি বানাতে চাইছেন কেউ কেউ। সুখে,
দুখে, শীতে, গ্রীষ্মে , প্রিয়ে অপ্রিয়ে সমজ্ঞান- গীতায় এই মহান শিক্ষা করে স্থিতপ্রজ্ঞ, সর্বত্যাগী হওয়ার ভেক ধরে সর্বগ্রাসী
হয়ে উঠছেন কেউ কেউ। সব বুঝেও গীতার কথা উচ্চারণ করা বোধ হয় তাই ঠিক হলো না। অবশ্য লোকে
বলে সময় বদলালে সব বদলায়। বদলায় কি আদৌ? এই
যে যেখানে সেখানে যে কোনো দলের মানুষ ইদানিং কেবল ভোট রাজনীতিকে সামনে রেখে গীতার ব্যবহার
করছেন, পাঠ করছেন করাচ্ছেন, গ্রন্থগীতা কি নিজে তাতে মত দেন?
“ইদং তে নাহতপস্কায়
নাহভক্তায় কদাচন।
ন চাহশুশ্রূষবে বাচ্যং
ন চ মাং যোহভ্যসূয়তি”
তপস্যাহীন ব্যক্তিকে গীতাশাস্ত্র বলবে না।
ভক্তিহীন ব্যক্তিকে গীতাশাস্ত্র বলবে না। শুনতে চায়না এমন কাউকেও বলবে না। অবিশ্বাসীকে
বলবে না। কেবলমাত্র ঈশ্বরে অসূয়াশূন্য, তপস্বী ভক্ত ও শুশ্রূষু ব্যক্তিকেই গীতাশাস্ত্র
বলবে।
কে শোনে কার কথা! সবই তাঁর রূপ। সবই তাঁর
লীলা! তিনিই গড়েছেন, দরকারে তিনিই তো ভাঙবেন! এই তো স্বাভাবিক নিয়ম।
এই যে লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জবুথুবু
বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন, আমার তো বেশ মনে হচ্ছে রাত পোয়ালেই লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে
খলবলিয়ে শিশু সূর্য উদয় হবেন। গোঁফের রেখা উঠতে তার আবার ছ’মাস কেটে যাবে। ছ মাস বাদে
যুবক সূর্য। তারুণ্যের প্রেম তার তখন মেঘের সাথে। লুকোচুরি, খুনসুটি, হাসিকান্নার সাক্ষী
হবে পৃথিবী। সেখানেও চলবে জীর্ণ জামা বদলের খেলা। পাতা ঝরবে, ফুল ফুটবে, ভোমরা গান
গাইবে। আলোর কাছে প্রার্থনা চলবে নতুন বছর মানবিক হোয়ার। ‘আরো আলো আরো আলো এই নয়নে
প্রভু ঢালো’। চেইন রিঅ্যাকশন বলবেন কেউ, কেউ বলবেন থার্মোডিনামিক্সের ফার্স্ট ল, কেউ
বলবেন নিত্যতা সূত্র, কেউ বলবেন গীতা, কেউ গ্রন্থসাহেব, কেউ কোরান, কেউ বাইবেল। আদতে
একজনই থাকবেন, একজনই হাসবেন রূপ বদলে বদলে। বদলের এই লীলায় তাঁর মেতে উঠবেন তিনি নিজেই।
মেতে উঠবেন ব্রহ্মাণ্ড। ইয়ৎ পিণ্ডে তৎ ব্রহ্মান্ডে!
Comments
Post a Comment