শাশ্বত কর
চেত্তা খেতে খেতে সবুজ-সাদা একটা লাট্টু ঘুড়ি এসে ঠোক্কর খেল ছাতে। অনেক সুতো। হাতপাট্টি করতে করতে হাত ধরে এলো যেন। নিজের মনেই হাসছিলাম। ছোটবেলার অভ্যাস- ঘুড়ির থেকেও সুতোর টান বেশি। পকেটে খাবলা খাবলা হাতপাট্টি করা মাঞ্জা। ঘুড়ি, সুতো কোনোটাই তো কেনার উপায় নেই! অবশ্য তাতে সমস্যা তেমন কিছু না। ঘুড়ির ধর্মই সুতো কেটে ভাসতে ভাসতে নতুন কোনও ঠিকানায় গিয়ে ওঠা। কাজেই ভোর ভোর হাঁটলেও গতকালের শেষ বিকেলের কাটা খাওয়া দু’ একটা ঘুড়ি মাঠে , উঠোনের কোণে নয় তো গাছে বাঁধা অবস্থায় মিলে যাবেই। কিন্তু সুতো তো আর সবসময় ওভাবে মেলে না! হাত্তা দিলে মেলে বটে, তবে তাতে যে পরিমাণ গাল শোনার সম্ভাবনা, তাই সে বেলতলায় আর যাই না! অতএব-
যেখানে দেখিবে সুতা,
দু আঙুল ঘুরাইয়া গুটা,
গিট্টু বাঁধিলে তায়,
লাটাই ভরে মাঞ্জায়!
হাতপাট্টি করা সুতোর গোছটা ছাতের মেঝেয় নামিয়ে রেখে ঘুড়িটা হাতে নিলাম। কড়িটানা ঘুড়ি! এখন দাম কত জানি না! আমাদের ছোটবেলায় অস্ট্রেলিয়ান কাগজের এমন কড়িটানা দেড়তে ঘুড়ির দাম ছিল বোধ হয় পাঁচ টাকা। সাধারণ কাগজের একতে ঘুড়ি ছিল এক টাকা, আধতে আটানা। বড় দাদাদের কেউ কেউ দোতে ঘুড়ি ওড়াতেন। কী টান! মাঠ থেকে কয়েকজন মিলে মোটা কাছি বেঁধে ইয়াব্বড় এক ঘুড়ি উড়িয়েছিল কয়েকবার! কী তার শব্দ! কী তার টান! বাপরে বাপ! কেউ বলত সেটা নাকি পাঁচতে ঘুড়ি, তো কেউ বলত ঢাউস! কোনটা ঠিক কে জানে! তার তুলনায় এ সব ঘুড়ি নেহাত ‘পতঙ্গ’ই বটে!
প্যাঁচ খেলতে গিয়ে ঘুড়িটার কলের একটা সুতো কেটেছে। সেটাকে ঠিক করব বলে হাতে তুলে নিতে মনে হলো উলটো দিকে কী যেন লেখা! ঘুরিয়ে দেখি সরু সরু অক্ষরে নাম লেখা – বঙ্কা। তার নিচে দুটো মুঠো বাঁধা হাতের ছবি আঁকা, পাশে আর একটু মোটা হরফে লেখা- “ওরা কাজ করে!”
বিশ্বকর্মা পুজো ছিল আজ। ছুটি। বিকেলে ছাতে পায়চারি করতে এসে হাতে পাওয়া চৌদ্দ আনা সুতোর বাকি দু আনা ঘুড়িটার লেখা বিকেলটাকে যাকে বলে একটু ঝাঁকিয়ে দিল। বিশ্বকর্মা- বিশ্বকর্মণ- দেবশিল্পী, দেবস্থপতি, দেবভাস্কর- বিশ্ব জুড়ে তার স্থাপত্য ভাস্কর্য আর প্রযুক্তির শিল্প। শিল্পী বিশ্বকর্মা। এই জগৎ চরাচরের সব প্রযুক্তির, সব শিল্পের স্থপতি। পুষ্পক বিমানের নির্মাতা; বজ্রপাশ, শতঘ্নী- মারণাস্ত্রের নির্মাণশিল্পী। ‘প্রকৃ্তিরহস্যজ্ঞানং শিল্পবিজ্ঞানদক্ষতাম’! ভাদ্র সংক্রান্তিতে তাঁর আরাধনা। রাত পেরোলেই শরৎ। মানে দুর্গাপুজোর শুরুয়াতি ঘন্টা। বিশ্বকর্মার পুজোয় শিল্পবিজ্ঞানের শ্রীবৃদ্ধি। বন্দনায় আছে- “তিনি দেবতাদের মহতি আশ্রয়, মহা প্রভান্বিত, শিল্পীদের ইন্দ্রস্বরূপ এবং সন্তান সন্ততিদের আশ্রয়স্থল”। মনে পড়ল, নারায়ণ সান্যাল তাঁর বাস্তুবিজ্ঞান গ্রন্থের মুখবন্ধে পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে ব্রহ্মার মানস পুত্র বিশ্বকর্মা রচিত ‘স্থাপত্য বেদ’ এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। বইটার পিডিএফ আছে মোবাইলে। সেটা খুলে দেখলাম পৌরাণিক ভাবনার পাশাপাশি ঐতিহাসিক চেতনার উল্লেখে তিনি লিখেছেন- “পূর্বেই বলিয়াছি, বাস্তুবিদ্যা বিষয়ে আর্যগণের প্রধান চিন্তানায়ক ছিলেন বিশ্বকর্মা। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তিনি গৃহ-নির্মাণ এবং নগর ও গ্রাম পত্তনের নিয়মাবলী ও বিধিনিষেধ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। বিশ্বকর্মা তাঁহার বাস্তু-বিদ্যা বা বাস্তুশাস্ত্রম গ্রন্থে সর্বপ্রথম গৃহারম্ভের “কাল-পরীক্ষা (Proper time for commencement) করিতে বলিয়াছেন। তৎপরে “দিক নির্ণয় (Orientation) , “দ্রব্য সংগ্রহ ( Collection of building materials), “ভূ-পরীক্ষা (Selection of soil and site), “ভবন-লক্ষণ (Planning of the house) প্রভৃতি পরিচ্ছেদে যেভাবে অগ্রসর হইয়াছেন, তাহাতে বিস্মিত হইতে হয়। মনে হয় না যে, গ্রন্থকার দ্বি-সহস্রাধিক বর্ষেরও পূর্বের একজন বাস্তুকার! মন্দিরের কার্যে বিশ্বকর্মা যে অষ্ট প্রকারের কাষ্ঠ এবং সাধারণ গৃহস্থ-বাড়ীতে যে ত্রয়োবিংশতি পর্যায়ের কাষ্ঠ অনুমোদন করিয়াছেন, তাহার অধিকাংশ আজিও আমরা ব্যবহার করি”।
পৌরাণিক হোক, ঐতিহাসিক হোক- আদত কথা, বিশ্বকর্মার শিল্প স্থাপত্য প্রযুক্তির কাছে নত হওয়ার, বন্দনার দিন আজ। শিল্পীকে, স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা জানানোর দিন। যদিও সময় বদলেছে, প্রেক্ষিত হয়তো বদলেছে! বদলাবেই না কেন? বিশ্বকর্মার বরপুত্র কন্যাদের সম্মিলিত প্রযুক্তি তে তো ‘পৃথিবী ছোট হতে হতে’ আপাতত মুঠোফোনে বন্দি। কাজেই বিশ্বকর্মা পুজোয় এখন আর দুর্গা পুজোর আভাষ পেতে চাওয়া সুনন্দর জার্নালে পড়া সেই ছোটোগল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়া পাওয়ার মতো- ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ধারে গিয়ে একটি গোলাপের পাঁপড়ি নিচে ফেলে প্রতিধ্বনি শোনার অপেক্ষা’! মেলে না, মেলার কথাও না। ছেলে মেয়েদের মধ্যে ঘুড়ি ওড়ানোর চলও অনেকটাই নিম্নমুখী। তাছাড়া কলকারখানা, বাস স্ট্যান্ড, রিক্সা স্ট্যান্ড, টোটো স্ট্যান্ডেই এখনও বিশ্বকর্মা পুজো অনেকটাই সীমাবদ্ধ। সেই অর্থে এখনও সবার নয়। মূলত যে সব শিল্পী, স্থপতিদের আমরা এক কথায় শ্রমিক বলেই অভিহিত করে দায় সারি- বিশ্বকর্মার সেই সব সন্তানদের আর কী! অবশ্য একটু ভুল হলো! একেবারে বিস্তার হয়নি, তা তো নয়! খানিক ছড়িয়েছে তো বটে! মধ্যবিত্তেরও তো এখন গাড়ি হয়। তাই কলকারখানা ছাড়িয়ে প্রাইভেট কার, বাইক, স্কুটি পুজোর চল হয়েছে ইদানিং ভালোই। সে ভালো! শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা তো প্রশংসনীয় বটেই। কিন্তু সমস্যাও একটা আছে। শিল্পের প্রতি শ্রদ্ধা আপাতদৃষ্টিতে ক্রমবর্ধমান হলেও শিল্পীর প্রতি উদাসীনতাও ক্রমবর্ধমান। যাঁরা ইট গাঁথেন, দেয়াল গাঁথেন, খিলান, ব্রিজ, শহর বানান- যাঁরা ঢালাইশিল্পী, যাঁরা কাঠ শিল্পী, বয়ন শিল্পী, চর্ম শিল্পী, ঝালাই শিল্পী- যাঁরা দেশে বিদেশে তাঁদের শ্রম, ধারণা, শিল্পের বিনিময়ে জীবন ধারণ করে চলেন- তাঁদের প্রতি সামাজিক উদাসীনতার, উপেক্ষার ছবি তো করোনাকালীন সময় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে! এখনও তাই! বিশ্বকর্মা পুজো সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে সেই সব শিল্পীদের একদিনের ভজন- ভোজন- পান- আনন্দের পরিসীমায়। একদিন পুজো হবে, তাঁরা একাত্ম হবেন দেবস্থপতির চেতনার সাথে, মনে জাগবে আশ্বাস- দেব শিল্পীর সন্তান তাঁরা, শিল্পের ধারক বাহক তাঁরা, বিশ্বকর্মা তাঁর সন্তানদের আশ্রয়স্থল। কিন্তু তিনি যে দেবতাদেরও মহতি আশ্রয়! আর যুগে যুগে দেবতাদের নব নব রূপ! মহতি স্থপতি নবরূপী দেবগণের জন্যও নিশ্চয়ই বানিয়ে দেন সম্মোহনী কল! তাই সময় আসে, সময় যায়, প্রদীপের কারিগরের ঘরে আলো নিভন্তই থাকে। এমন টা না হলে সামাজিক দেব দেবীদের চলবেই বা কেমন করে! এমন আধার না থাকলে কোথায় আর তারা তাদের আশ্বাসের ধারা বর্ষাবেন ভোট পুজোর সময় হলেই? আশ্বাসের বৃষ্টি হবে তুমুল, চাপ পড়লে খানিক পুষ্পবৃষ্টির মতো মিহিদানাও ঝরবে। খিদে দেবীর মায়ায় আত্মবিস্মৃত বিশ্বকর্মার সন্তানেরা সব ভুলে হাত পেতে গ্রহণ করবেন সেই অন্ধকারের দান! যুগে যুগে রাজার ঈর্ষা , আশঙ্কা চরিতার্থ করতে হাতের পাঞ্জা কাটা যাবে আশ্চর্য স্থপতির। তবুও খিদে দেবীর মায়ায় আত্মবিস্মৃত বিশ্বকর্মার সন্তানেরা হাত পেতে গ্রহণ করবেন দানা! এই তো নিয়ম। নিয়মের ব্যতিক্রমে প্রাপ্য সম্মানের জন্য কখনও যদি কেউ ঘুরে দাঁড়ান, কখনও যদি মুঠো হয় হাত, মুঠো হাতে ঝলসে ওঠে মাঠের ফসল তোলা কাস্তে, পথ গড়ার কারিগর গাঁইতি, ইট গাঁথার শিল্পী কন্নিক, পাথর ভাঙ্গা ভাস্কর হাতুড়ি- সিংহাসন আর তার আশপাশের সবাই বসবেন মন্ত্রনায়। চুপিচুপি, লুকাছুপি। কে সরকার, কে বিরোধী- কিচ্ছু বোঝা যাবে না! শত্রু, সুহৃদ- সব রকম সাজে সেজে সবাই মিলে মিশে যাবেন তরঙ্গে। তরঙ্গ ভাঙতে সব রকম চেষ্টা চলবে। যতদিন লাগে লাগুক, কুছ পরোয়া নেহি! তরঙ্গ রুখতেই হবে । সুদূর অথবা নিকট ইতিহাস তো তাই দেখায়।
উদোমের নেই বাটপারের ভয়। বঙ্কার নামের পাশে নিজের নামটা লিখলাম। যতটুকু সুতো আছের ওড়াই। তারপর সুতো ছিঁড়ে দেব ঘুড়িটার। শুনেছি, বাবুরা নাকি সে সময় একশো টাকা দুশো টাকার নোট বেঁধে উড়িয়ে দিতেন ঘুড়ি। হুড়োহুড়ি পড়ে যেত নাকি সে সব ঘুড়ি ধরার জন্য! বঙ্কার হাত ঘুরে আজ আমিও উড়িয়ে দেব অক্ষর! হুড়োহুড়ি না পরুক কারও হাতে গিয়ে তো উঠবে!
আরও কতগুলো ঘুড়ি কেটে গেল! চেত্তা খেতে খেতে একটা লাল হলুদ পেটকাটি ভেসে আসছে ছাতের দিকে। অপেক্ষা করছি। আশা ভাসছে চোখে- আকাশ জুড়ে
উড়ে যাচ্ছে ঘুড়ি, ঘুড়ির বুকে ভেসে যাচ্ছে অক্ষর… সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে অমোঘ অক্ষর –
শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে
ওরা কাজ করে
Khub sundor hoyeche Sir 👏👏
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Delete