শাশ্বত কর
সুপ্তপর্ব
“যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে!
গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!”
ঠাকুর দালানে ধুনুচি সাজানো হচ্ছে। এও এক শিল্প! নারকেলের ছোবড়া উল্টো করে এমন করে সাজা হবে যে ধুনুচি নিম্নমুখী হলেও সহজে পড়বে না! নইলে আরতি জমবে কেমন করে!
ছোবড়া চুঁইয়ে ধোঁয়া মিশছে বাতাসে। বাতাসে ধুনোর গন্ধ! বাতাসে কর্পুরের গন্ধ! বাতাসে শিউলি, ছাতিম, বাতাবি ফুলের গন্ধ! বাতাসে ঠান্ডা আদর! আদর আমার গালে। মায়া আদর, আচ্ছন্ন আদর। যে সুগন্ধী বাতাস নাকি গোলাপের মৃদু পাঁপড়ি এই আদর এঁকে গেল, এই তো খানিক আগে যখন তেতলার চক বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচে ঠাকুরদালানের পাশে রাঙাপিসিমাদের আড্ডা দেখছিলাম, তার নাম এখানে লেখার কীই বা দরকার? গতকাল সকালে পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা সেই আমায় দিয়েছে, ভিড়ের অছিলায় আঙুল ছুঁয়ে গেছে। কাছে আসলেই মায়ের পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা আমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক পুব বাগানের বাঁধানো বেদির পাশে রাত আলো করে থাকা নিশিপদ্মের মতো! এ গন্ধের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা! এখন যেমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি চক বারান্দায়। হাতে শ্রীশঙ্খ!
ঠাকুর তোরঙ্গ থেকে বড় শাঁখখানা আনতে পাঠিয়েছিলেন রাঙাপিসিমা। সারা গায়ে কাজ করা সোনা বাঁধানো এই শাঁখটা আমার খুব প্রিয়! কেবল নবমীর সন্ধ্যেতেই এই শাঁখ বেরোয় তোরঙ্গ থেকে। গেল বছরও লম্বায় আমার এক হাত ছিল। এ বছর আমার কবজি ছুঁয়েছে। এবার বাইরে থেকে যত আত্মীয় এসেছে, সবাই বলছিল আমি নাকি বেশ ঝাড়া দিয়েছি। নাকের নিচে সরু গোঁফের রেখাটা বাদ দিলে মুখখানা নাকি আরও মায়ের মতো হয়ে উঠেছে।
মা! শব্দটা বললেই পুজোর সময় আমার চোখে জল আসে। তখন ক্লাস ফোর- বিজয়া দশমীর ভোরের আলো ফুটছে- মাকে নিয়ে সবাই চলে গেল। মা দুর্গা তখনও ঠাকুর দালানে- মা চলে গেল! রাঙাপিসি ডান হাতে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বাঁ হাতে আমায় বুকে টেনে বলল, ‘মা আজ তোর বাবার কাছে গেল রে!’ ফুলদাদু সন্ধ্যেবেলায় দুর্গামাকে দেখিয়ে ধরা গলায় বললেন, ‘ওই তোমার মা!’
তারপর ন’বছর পেরিয়ে এবার দশ। মা এসেছে। পুজোর ভিড়ে মাকে কাছে পাই না। আগেও অবশ্য পেতাম না পুজোর দিনে। মা, ছোটমা, সোনামা- সবাই তো সেই মহালয়ার আগে থেকেই গোছগাছে লেগে যেত। রাঙাপিসিমা নিয়মকানুন বলে দিতেন। আমাদের পুজোর তো আবার হাজারো নিয়ম। দাদুরা সবাই বলেন- দুর্গামা না কি এ বাড়ির মেয়ে। কৈলাশ থেকে বাপের বাড়ি আসে। তাঁকে আনার জন্য তাই শ্বশুরবাড়িতে নেমন্তন্ন পাঠাতে হয়। নেমন্তন্নর চিঠি লেখা হতো সব দিদিদের শ্বশুরবাড়িতে। আর দাদুর উমা মায়ের নেমন্তন্নের জন্য দুপুর হলেই হতো চন্ডীপাঠ, আর সন্ধ্যে হলেই আগমনী গান। ফুলদাদু গাইতেন, নীলুদাদু গাইতেন, ঝড়োদাদু গাইতেন, রাঙাপিসি, ন’পিসি, বুলা পিসি, মা গাইতো- সে এক অদ্ভুত মায়ার আসর! মায়েদের আরও কত কাজ! পুজোর বাসন কোসন, মায়ের গয়নাগাঁটি, শাড়ি, আলতা, সন্দেশের সঞ্চ, নারকেল, চিনি, ঘি, মধু- আরও কত কী- সব সপ্তমী অষ্টমী নবমীর হিসেবে গুছিয়ে নেওয়া! পুজো শুরু হলেই তো শেষ! তখন কী আর তাল পাওয়া যাবে অত মানুষের ভিড়ে!
নীচ থেকে রাঙাপিসি দেখে আমায় হাত নেড়ে ডাকছে। শঙ্খটা নিয়ে যেতে হবে! রাঙাপিসির পাশে যে দু’জন এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের খেয়াল আমি দাদুর সাথে আমি টিভিতে দেখেছি। আজ নবমীর গান তা হলে ওঁরাই গাইবেন।
ছোটকাকু বড় শাঁখে তিন বার ফুঁ দিতেই ঢাকে কাঠি পড়ল। আরতির বাজনা। দীপ, ধুপ, বস্ত্র, পুষ্প, চামর দিয়ে আরতি চলল। মায়ের চোখ জ্বল জ্বল করছে। আমারও চোখ জ্বালা করছে। আজই তো শেষ। চোখে দেখতে পাওয়া, পা ছুঁয়ে প্রণাম করার মা যে আবার চলে যাবেন এক বছরের জন্য।
মা চলে যাওয়ার পর থেকে আমাদের এ বাড়িতে বিসর্জনের বাজনা বাজে না। নবমীতেই যা পুজো। দশমীর পুজো তিথি মেনে হয়, ঢাক বাজে না। দর্পণে বিসর্জন। পুরোহিত দক্ষিণা। ঢাকিদের বকশিস। সব সেরে কাকু আর দাদারা নিঃশব্দে দুর্গামাকে নিয়ে যান গঙ্গায়। ফুলদাদু এসে আমার হাত ধরে বলেন, ‘মা তো এখন থেকে সব সময় তোমার সঙ্গে থাকবেন দাদা। বিসর্জন তো চলে যাওয়া নয়। মায়ের মিশে যাওয়া তাঁর সৃষ্টিতে। চিন্ময়ী মা। মৃন্ময়ী মা আবার আসছে বছর আসবেন বাড়িতে!’
কাকিমার সাথে দিদি, বোনেরা মিলে বিজয়ার জন্য হলঘর সাজাবে। সেখানে সবাই বসবেন সন্ধ্যে হলে। প্রণামে, আলিঙ্গনে, মিষ্টিতে ভরে উঠবে বিজয়া। রাঙাপিসিমা বলবেন, ‘আগে এ বাড়িতে বিজয়ায় ভিয়েন বসত। আশু ময়রা কুলিয়ে উঠতে পারত না মিষ্টি বানিয়ে। তার সঙ্গে নাড়ুবড়ি, ক্ষীর- বিজয়া মানে সে এক এলাহি কারবার! ঢাকি, কুমোর পরিবার থেকে শুরু করে যত জ্ঞাতিগুষ্টি-সবাই আসতো। ধম্ম কম্মেরও বাছ বিচার ছিল না এ বাড়িতে। হিন্দু, মুসলমান, সাহেব সুবো- সবাই নাকি এসে মিষ্টিমুখ করত, পাত পেড়ে খেত এক সময়! বিজয়া তো নয়, সে যেন এক মিলনোৎসব!’
নীচে যেতে যেতেই ফুলদাদু পথ আটকালেন। টুকটুকে হাত ভর্তি পোস্টকার্ড! দাদু এখনও নিজে বিজয়ার পত্র লেখেন। আমাকেও লিখতে হয়। সবার আগে মাকে লিখতে হয়-
“শ্রীচরনেষু মা,
ঁবিজয়ায় আমার প্রণাম নাও! আশা করি যাত্রা শুভ হয়েছে। আমি ভালো আছি। রাঙা পিসি, ফুল দাদু- সবাই আমায় খুব ভালোবাসে। তুমি আমার চিন্তা কোরো না, ভালো থেকো। আসছে বছর আবার এসো মা গো!”
বিজয়ার সন্ধ্যায় আমি লিখব আর ফুলদাদু দেখবেন। দেখতে দেখতে ফুলদাদুর মুখ লাল হয়ে যাবে, তবু কাঁদবেন না! যদি আমি কাঁদি!
আদিপর্ব
“তিনদিন স্বর্ণদ্বীপ জ্বলিতেছে ঘরে
দূর করি অন্ধকার;……”
ওপরে যা সব লেখা পড়লেন, হে সুজন পাঠক, করজোড়ে মার্জনা চেয়ে বলি- রীতিনীতিগুলো ছাড়া সে সব কোনোটিই সত্যি নয়। রীতিনীতিগুলো যা অল্পবিস্তর আছে সে আমার পাঠলব্ধ অভিজ্ঞতা বই আর কিছু না। আমি আসলে এরকম ভাবতে ভালোবাসি। যদি এই নির্দেশতন্ত্রে না থেকে আমি নামক শরীরটি ওই নির্দেশতন্ত্রে থাকত তবে ঘটনাক্রম ঠিক কেমন কেমন হতো- সে সব ভাবতে আমার বেড়ে লাগে! কখনো হাসি পায়, কখনও চোখ ভেজে। এ অভ্যেসের মেলা সুবিধা আছে। যে সব দৈনন্দিন জ্বালাযন্ত্রণা নিম্নমধ্যবিত্ত নামক যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁত চিপে সহ্য করতে হয়, আমার ওই অভ্যেসটি সে সব বিন্দুমাত্র স্থায়ী হতে দেন না। এই যে যেমন খানিক আগে বাড়িতে মা ঠাকুমার এক চোট হলো! প্রায়ান্ধকার গলির ঘ্যাঁষ ছড়ানো রাস্তা- সবুজ টিউবের আলোর পাশে সাইকেল ঠেকনা দিয়ে মাইকে কুমার শানুর পুজোর গান শুনতে শুনতে একা একা বেশ ভাবছিলাম। তারপর ভাবনাটা একটু বেলাইনে চলে যেতেই মায়ের মুখটা ভেসে উঠল, আর আমিও বর্তমানে ফেরত চলে এলাম।
আজ নবমীর রাত। কাল দশমী। গৌতমের মার থেকে তিনটে নারকেল কেনা হয়েছে। গৌতম আমার বন্ধু বলে কাকিমা দুটো ফাউ দিয়েছে। মা আর ঠাকুমা পারস্পরিক কচকচির মধ্যেই ট্রাঙ্ক থেকে বাসন কোসন বার করছে দেখে এলাম। এবার তেঁতুল বেরোবে। ঝকঝক করবে বাসন কোসন রোদ নিতে নিতে। আগামীকাল সকালে বাবার সাইকেলের ডান হ্যান্ডেলে ঝুলতে ঝুলতে আখের গুড়, চিনি, বাতাসা, মঠ, মিশ্রি আসবে। বাম হ্যান্ডেলে থাকবে পুজোর ফুল, পল্লব, ঝরামালা, আর শোলার কদম। সাইকেলের একদম সামনে হুক থেকে ঝুলবে মাছের থলের ভিতর জোড়া পুঁটি।
দশমীতে যাত্রা ঘট পাতা হবে বাড়িতে। কেন যেন মনে হয় এ রীতি দুর্গাপুজোর সংক্ষিপ্ততম রূপ। আমরা ওপার বাংলা থেকে তাড়া খেয়ে আসা বাঙালী। আমরা মানে আমার বাবা, মা- ঠাকুমা। আমার জন্ম অবশ্য এদেশেই। সে যাই হোক, মনে হয় কোনো পুরুষে হয়তো বাড়িতে দুর্গাপুজো হতো, তারপর অবস্থা পড়ে গেছে- আর হয় না। সংক্ষিপ্ততম রূপ হিসেবে বারোয়ারি মন্ডপে মহাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি, মায়ের বরণ আর গৃহে মায়ের শুভযাত্রার প্রার্থনায় যাত্রাঘট পাতার রীতিটি কেবল আছে।
পুজোর ঘরে মা বসবেন ঘট সাজিয়ে। বাড়ির সামনের স্থলপদ্ম গাছে কাল ঝেঁপে আসবে গোলাপি ফুল। ঘটে সাজবে সিঁদুরের ফোঁটা। ঘটের পাশে সিঁদুরের ফোঁটায় সাজবে জোড়া পুঁটি। নব সাজে পুঁটিকে তখন দেখতে লাগবে কচি ইলিশের মতো। আর এক পাশে নাড়ু, তক্তি, ক্ষীরের সাঁচে, মঠে, মুড়কিতে ভরে থাকবে পাত্র। দূরে মেঝের ভাঙা খাঁজে অপেক্ষা করবে কালো পিঁপড়ের দল! শোলার কদমে পড়বে সিঁদুরের ফোঁটা। দরজার শিকলের খাঁজে পুরোনো সরিয়ে নতুন কদমের সুতো বাঁধবে বাবা। শিকলের নিচে দরজার কাঠে সিঁদুরের ফোঁটা দেবে মা। সিঁদুর খেলা হবে মন্ডপে। দুর্গা মায়ের সামনে থাকবে কাঠের হাই বেঞ্চ। বেঞ্চের উপরে উঠে মায়েরা বরণ করবেন মাকে! মায়েদের মুখ আর মায়ের মুখ তখন এক। মায়েরা পান দিয়ে বরণ করবেন , সন্দেশ খাওয়াবেন, জল খাওয়াবেন সসন্ততি, সবাহন মাকে। তারপর মায়ের সামনেই মায়ের মত করে সিঁদুরে রাঙাবেন নিজেদের। এ সিঁদুর খেলা মনে হয় বিজয়োৎসব। মায়েদের বিজয়োৎসব। ন’ দিন ন’ রাত ধরে লড়াই শেষে মহিষাসুরমর্দিনী মায়ের বিজয়োৎসব। রোজ রোজের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মায়েদের যন্ত্রণা হারানোর বিজয়োৎসব। পার্থর মা, গৌতমের মা, রুমকির মা, টুপাই-এর মা আর মহিষাসুরমর্দিনী মায়ের এক হয়ে যাওয়ার বিজয়োৎসব। এসব অবশ্য আমার ধারণা। সঠিক আমি জানি না। জানেন হয় তো পন্ডিতরা। কোনোদিন পন্ডিত হতে পেলে আমিও জানব।
বরণ শেষে মা আসবেন। প্রণাম করব মাকে। ছোট প্যাকেট থেকে লাল হয়ে যাওয়া সন্দেশের একটা কোণা ভেঙে আমায় দেবেন। প্রসাদ। ফুল দেবেন। আশীর্বাদ। বইয়ের মাঝখানে যাবে ফুল। আশা। ঠাকুমা মাকে বকবেন। বিজয়ার নাড়ুবড়ি মিষ্টি সাজাতে বলবেন। রোজনামচা।
সন্ধ্যে হতেই পাড়ার কাকু কাকিমারা আসবেন। মোড়ায় বসবেন। চেয়ারে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হবে। সোফাটা আরেকটু বেঁকে আপত্তি জানাবে। বাবা হাসিমুখে আপ্যায়ণ করবেন। আলমারির পাশে ঢোলা হাফশার্ট- হাফপ্যান্টে সাজব আমি। স্টিলের প্লেটে সেজে উঠবে গুড়ের নাড়ু, চিনির নাড়ু, তক্তি, ক্ষীরের সাঁচ, গজা, মিহিদানা, মুড়কি আর কুচো নিমকি। খাওয়ার আগে প্রণাম হবে , আশীর্বাদ হবে, কোলাকুলি, আলিঙ্গন হবে। বিদায়ের শেষে তাঁদের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাবেন। রাত দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত অতিথি আসবেন। আশেপাশের বাড়িতে বিজয়ার মিষ্টি দেওয়ার জন্য থালা সাজিয়ে দেবেন মা। অন্ধকার দেখে ঢাকা তুলে সেখান থেকে দু’ চার পিস হাপিস করে দেব মিচকে ভালোমানুষ আমি। যার বাড়িতে যাব, সেখানে প্রণাম সারার পর ওই থালাই ফের ভরে উঠবে তাদের বাড়ি থেকে। আমার জন্য আলাদা করে প্লেটে আসবে গজা, দানাদার, নিমকি নয়তো ঘুগনি। সে বাড়ির থুত্থুড়ে ঠাকুমা বাবার কথা জিজ্ঞেস করবেন, ঠাকুমার কথা, মায়ের কথা জিজ্ঞেস করবেন। খেতে খেতে আড় চোখে দেখব সে বাড়ির পুঁচকি খাটের পাশ থেকে ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে হয় তো ইশারায় বলছে, ‘বলব? বলব?’
এ সব চলবে আরও কয়েক দিন। এ পাড়ায় ও পাড়ায় বিজয়া সম্মিলনী হবে। এ সবের মধ্যেই একদিন ফাঁকা বিবিধভারতীর দুপুরে বিছানার তলা থেকে ইনল্যান্ড লেটার আর পোস্ট কার্ড বের করবে মা। মেঝেতে বসে নিজেই লিখবেন-
শ্রীচরণেষু মা,
তুমি আমার ঁবিজয়ার প্রণাম নিয়ো। দাদা, বৌদিদের আমার প্রণাম জানিয়ো। পুলককে আমার ভালোবাসা দিয়ো। রাজু, মিঠু, মালা, মানু, তাপুদের আমার স্নেহাশীষ দিয়ো। আমরা একপ্রকার কুশলেই আছি। ……
লেখার শেষে খানিকটা জায়গা আমার জন্য বরাদ্দ। আমায় ডেকে সেখানে লেখাবেন,
দিদা আমার ঁবিজয়ার প্রণাম নিয়ো। বড়মামা, মেজমামা, ছোটমামা আর সব মামীদের আমার আমার ঁবিজয়ার প্রণাম জানিয়ো। দিদি, দাদা, ভাই…
বিবিধভারতী বাজাবে অনুরোধের সুর- ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া!’
সমাপন পর্ব
“বার মাস তিতি, সত্যি, নিত্য অশ্রুজলে,
পেয়েছি উমায় আমি”
ডায়েরিটা খুঁজে পেয়েছি শ্বশুরবাড়ির দেড়তলার ঘরে। আমারই সুপ্ত ইচ্ছা গুপ্ত কথার হিজিবিজি ভরা ডায়েরিখানা পারিবারিক সেফটি রিজনে দিয়ে রেখেছিলাম একদা বন্ধু অধুনা গিন্নির সেফ কাস্টডিতে। সে প্রায় বছর উনিশ কুড়ি আগে। তারপর তিনি রেখেছিলেন তাঁর ট্রাঙ্কে। তারপর বিয়ে থা, চ্যাঁ ভ্যাঁ, দায়িত্ব, কর্তব্য, কাগজ কলমের ধুলোঝড়ে সে সব মাথা থেকে কবে বেরিয়ে গেছে। মাথা থেকে ইচ্ছে টিচ্ছে সব গুটিয়ে গিয়ে সেখানে পতপত করে উড়ছে ট্রেন্ডি দিনকাল। সবই সমাজ। কারা যেন সমাজ বদল চেয়েছিল, চালাক চতুরদের সুকৌশলী ঘুঁটি বদলে সে বদল এমনই ট্র্যাজিক হলো যে তারাই একেবারে একঘরে হয়ে দাঁড়াল। ঠিক যেন একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত- যাদের এখন খুঁজেই পাওয়া যাবে না। হুসহুসিয়ে উড়ছে উন্নতির ধ্বজা। হুড়হুড়িয়ে দৌড়চ্ছে রথ। বেশভূষায় তো নয়ই, বাসস্থানে খানিক খুঁজে পেলেও রীতিনীতিতে ততটা আর মিলবে বলে আমার মনে হয় না। না মেলাই ভালো। সর্ব মঙ্গল ভব! সার্বিক উন্নতি ইজ আওয়ার উন্নতি! উন্নতির বিপক্ষে যারা তারা হয় বুদ্ধু নইলে জেলাস!
হেঁইয়ো! ট্র্যাকে ফিরে এসো বস!
এই হয়েছে ইদানিং। উন্নতির রথে চেপেছি ঠিকই, দৌড়চ্ছিও- কিন্তু স্বভাব যায় না মলে! মাঝে মধ্যেই উড়ুউড়ু মন, কুলুকুলু জল, ঢুলুঢুলু চোখ! মন গাছ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে, আশপাশ ছাড়িয়ে, উঁকি দেয় আকাশে। চিদাকাশ। শূন্য। ধূসর। যেটুকু দাগ ছাপ আছে তাও অনেক হালকা। ছাড়া ছাড়া কাশের রেণুর মতো কচি তুলোট মেঘ। অবকাশ নামক প্রায়াবলুপ্ত শব্দের সম্মুখীন হলে সে সব তুলোর মেঘ ভিড় করে আসে। গাছপালা, মাকড়শা, ব্যাঙের ছাতা, আলোকলতা, কচু, ঘেচু, অর্কিড, নারকোল, হাঁড়িচাচা, বেজি- নিরিবিলি এই মরুদ্যান- এমন অবস্থা গাঢ় হওয়ার ক্যাটালিস্ট, মাইকে ভেসে আসা পুজোর মন্ত্র আর হঠাৎ পাওয়া ডায়েরিটা হলো ক্যাটালিস্ট প্রোমোটার।
মনে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে স্মৃতি। অশোক, বকুল আর কৃষ্ণচূড়া ছাওয়া বিতানে বিকেলে সন্ধ্যায় পায়চারি করতে করতে মন সরে যাচ্ছে বর্তমান থেকে। মশার মতো দু পায়ে তেড়ে কামড়ে যাচ্ছে বর্তমান। মোবাইল ফোনের মতো সুইচ অফ করে দিয়েছি বর্তমান। মা আছেন তিনদিন! কলার উঁচু আমার! কী করার আছে করে নে!
নবমীর রাতে দূরদর্শনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডিং দেখিয়েছে। দোতলার প্রায়ান্ধকার বারান্দায় বসে বসে শুনেছি। লিচুর ঘন পাতায় অন্ধকার থুবু। কালো ডানা মেলে রাতপাখির উড়াল। মাইকে মহানবমীর মন্ত্রোচ্চারণ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন-
নবমী নিশিরে তোর দয়া নাইরে
এত করে সাধিলাম
তবু হইলি ভোর
হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে? কখন মনপাখি সেই ডায়েরির পাতা ছুঁয়ে উড়ে বনেদি বাড়ির অচেনা মা হারা ছেলের জন্য চোখ ভিজিয়ে দেয়। বাবার সাইকেলের ঘন্টিতে জোড়া পুঁটিমাছের দাম শুনতে পায়!
আসলে মা এ’জন্যেই বছরে বছরে আসেন। মা আসার আগে গেরস্তের ঘরের ধুলো ঝাড়া হয়। মায়ের কাছে চারদিনে মনের ধুলো ধুয়ে যায়। মা ছাড়া যে সন্তান হেলা ছেদ্দায় এপাশ ওপাশ ধাক্কা খায়- মা কি তা জানেন না? জানেন বলেই আসেন। কোটি সন্তানের কোটি দুঃখ, কোটি সাধ। যশো দেহি, আয়ুর্দেহি…. দাও, দাও, দাও মা! দেওয়ার জন্যেই তো তুমি মা। নিঃস্বার্থভাবে শুধু দেবে। হাত পেতে কেবল নেব। জন্মদাত্রী মায়ের থেকে নেব, আশ্রয়দাত্রী মায়ের থেকে নেব। তুমি তো সবার মা- তাই তোমার থেকেও নেব। চেয়ে নেব, কেঁদে নেব, চেঁচিয়ে নেব। তারপর ভুলে যাব। রাস্তায়, ঘরে, কাজের জায়গায় সবখানে তোমার অপমান অসম্মান দেখেও মুখ টিপে চুপ করে থাকব। পুজোর আগে তোমায় অসম্মান করা অসুর ছাড়া পাবে, তার দাদা অসুর আরও বড় স্তরে বকধার্মিক হয়ে দাপাবে- সবখানে চুপ করে থাকব। তুমি তো মা। সন্তানের অক্ষমতা, ক্যালাসপনা ঠিক ঢেকেঢুকে সমৃদ্ধিতে ভরে দেবে। সমৃদ্ধি পেলেই তোমায় হাওয়া করে দেব! তোমার তিথিসম্মত বিদায় নেওয়ার আগেই মোবাইল খুলে সবার আগে ‘শুভ বিজয়া’ পোস্টাব- ভার্চুয়াল মিষ্টিমুখ- ভার্চুয়াল আশীর্বাণী! উন্নতির জয়রথে টপ টু বটম- আনন্দ হি কেবলম!
তবে ভয় হয়! পুজো মন্ডপে চেয়ারের উপর চেয়ার তুলে যখন তোমায় বরণ করে, তখন তোমার মুখ, গিন্নির মুখ, মায়ের মুখ এক হয়ে যেতে দেখে ভয় হয়। সিঁদুর খেলায় রেঙে ওঠা গাল, তোমার শক্তি চুঁইয়ে আসা চোখ দেখে আশা জাগে! নিশ্চয়ই ঝলসে উঠবে বজ্র, তীব্র ঘূর্ণনে ঘুরবে সুদর্শন চক্র- তোমার দশ হাতের অস্ত্র মাটির মায়েদের কোটি হাতে। যুথ সোচ্চারে আকাশ বাতাস কাঁপবে! হাঁটু মুড়ে বসবে অসম্মানের অশুভ। থর থর কাঁপবে। তোমাদের সেই শক্তির পাশে নতজানু হয়ে ভিক্ষা করবে বকধার্মিক- দেবী দুর্গা প্রসীদ!
অপেক্ষা করে থাকি মা গো! কবে ওই তীব্র ত্রিশুল ভেদ করে যাবে মর্ম আমার! সব পাপ, সব পুণ্য, সব যশ, সব দর্পর বিসর্জন হবে দর্পণে! চিদাকাশে অসুর দলনী মায়ের বিজয় সুরে ভেসে উঠবে বিজয়া। বিজয়োৎসবে মিষ্টিমুখ করিয়ে মায়ে পোয়ে এক হয়ে যাব আকাশে বাতাসে। তবেই না শিউলির সারল্য ভরা এই মনে ফুলদাদু ফের তোমার প্রতিমা দেখিয়ে বলবেন, ‘এই তোমার মা!’ তবেই না পুজো শেষে সসন্ততি কন্যা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কালে মা বলবেন ‘যাই বলতে নেই, বল আসি!’ দেবী মা মিলে যাবেন পার্থীব মায়ের আসনে। বাতাসে ধ্বনিত হবে মায়ের সকরুণ সুর-
“এসো মা, এসো মা উমা
ওমা বোলো না তো যাই যাই
মায়ের কাছে হৈমবতী
ও কথা তো বলতে নাই!”
--ঃ--
প্রকাশিত- আজকাল.ইন, রবিবার অনলাইন , 29.10.2023
Comments
Post a Comment