নাত্মানমবমন্যেত। ন হ্যাত্মপরভূতস্য ভূতির্ভবতি শোভনা- দর্প নয় পরিত্যাজ্য, কিন্তু
অন্তরজগতে যেই আমি, তিনি তো বাইরের আমির থেকে আলাদা কেউ নন। ধুলোয় বালিতে রেণুতে
কণায় মিশে রয়েছেন যেই আমি, আলোয় আবছায়ায় অন্ধকারে মিশে রয়েছে যে আমির কণা কণা
অস্তিত্ব, সেই একের কথা ভুলে গিয়ে কোনো স্বভাব্জনিত অভাব ভাবনায় যিনি দীনহীন ভেবে নিজেকে
কোণে ঠেলে দেন, যাপন বেলার গেরোয় ভরা খেরোর খাতা মিলিয়ে নিয়ে কেবল শ্বাস লম্বা হয়
যার, ভেঙে যাওয়া আয়নাতে মুখ দেখে দেখে খুশি হবার অভিনয়ের অভ্যাস করতে করতে যিনি
ভুলে যান মুখের অবয়ব, হতাশায় অবমাননা করেন মুক্ত আত্মার , শোভন ঐশ্বর্যের খোঁজ তার
আর পাওয়া হয় না।
আর যেই হোন, কবি কখনও সে পথে হাঁটেন না। পরম ঐশ্বর্যের যে ভোর ঘোর লাগায় তার ভিতরের চোখে, সেই চোখের আলোয় দেখেন তিনি চোখের বাইরের চরাচর। দিন রাতের চক্র, বৃষ্টি মেঘের খেলা এক এক করে পর্দা সরিয়ে নেয় কবির চোখে। ক্রমশঃ সমস্ত পথ অভিসারী হয়ে আসতে থাকে একটিমাত্র রেখায়। সেই তো কবির দর্শন। তার একান্ত নিজস্ব দর্শন। সেই দর্শনে কবি এবার চিন্তাকে চাইলে অপসারী করেন। বইয়ে দেন বয়া নয়া নয়া স্রোতে। অভিযাত্রার যা কিছু সঞ্চয় অনশ্বর অক্ষরমালায় অজান্তেই কবির আঙুল ছুঁয়ে কবিতার রূপ পায়।
“এক অক্ষর বালিতে লিখি, এক অক্ষর জলে
কী জানি কী নিয়তি ছিল, এক অক্ষর লিখেছি কপালে
এক অক্ষর উড়িয়ে দিই, এক অক্ষর যত্নে রাখি টবে
ভেঙে ভেঙে সেই অক্ষর ফুল হয়ে ফোটে কি মতলবে
এক অক্ষর উচ্চাকাঙ্ক্ষী, এক অক্ষর শেষ পঙক্তিতে
আসে
এক অক্ষর উহ্য থাকে অহেতুক সম্পর্কের পাশে
সব অক্ষর জড় করলে আমার দেখি এক অক্ষরও নেই
যা লিখেছি শুরু থেকে সব কিন্তু তোমার অক্ষরেই”
কালি কলম মন- তিনের সংযোগে
যে রসায়ন, সেখানে আর কারোর অধিকার নেই। সে নিজেই কবি গাছের ফুল। অথচ মজার বিষয় হল,
ফুল কিন্তু কবির ইচ্ছাধীন নয়। চাইলেই এ ফুল ফোটাতে পারেন না কবি, রূপকথার গল্পের
সেই কেয়া ফুলটির মতনই আকাশে মেঘ ছাইলে, বিদ্যুতের তলোয়ার নেমে এলে সুগন্ধ বুকেনিয়ে
আপনিই ফোটে। আর পাঁচটা ফুল ফোটার মতনই এই প্রসবও স্বতঃস্ফূর্ত। কাজেই খানিক
বিশৃঙ্খলও। অবশ্য এই শৃঙ্খল যে কতখানি আপাত, কবিমন ছাড়া সে বোঝার ক্ষমতা কার?
বিজ্ঞান বলেন, প্রতিটি
সম্পর্ক তৈরি হয় স্থায়িত্বের চাহিদায়। অজানা, অচেনা খাতের নানান স্থায়িত্বের খোঁজে
নানান ঢঙে মেতে ওঠে রসায়ন- এরই নাম সম্পর্ক। আর কবি দেখেন চরাচর মানে সার সার
গাছের নিবিড় অরণ্য। গাছে গাছে অনায়াস বন্ধন হয়, আবার সে বন্ধন ছিঁড়ে যায় নতুন
জন্মের দিকে। এ তো অমোঘ। হারানোর ভয় ঘিরে ভাঙাচোরা সম্পর্কের গাছের ছায়া আগলে বসে
থাকেন যে গাছ, কবি তো তা নন। তিনি সত্য চেনেন। তিনি সত্য দেখেন। জন্ম নেই, মৃত্যু
নেই, কেবল মহাশূন্যে বয়ে যাওয়া আছে। বহমান সে কবিকণা যখন যে ক্ষেত্রের প্রভাবে,
তখন তেমন করে জমাট বাঁধা গাছ। আদি অন্ত হীন নিত্য মুক্ত বুদ্ধ বৃক্ষ। এ চেতনা যার,
তিনি তো স্বাভাবিক প্রতিবাদ করবেন নদীস্রোতে বাঁধ দেয়ার। পাখি উড়ে গেলে কেবল পড়ে
থাকা যে ছায়া, অথবা নির্জনতা তাকে আঁকড়ানোর নামই মেনে নেওয়া। মেনে নেওয়ার কাছে
নিজেকে বেঁধে দিতে চিরকালই অসমর্থ কবি। যত্নে রাখা ক্ষণ যদি বা বদলে যায়, সময়
তন্ত্রে হারিয়ে যায় মিলিয়ে যায়- দুঃখ পেলেও তাকে মেনে নেয়ার ক্ষমতা কবি ধরেন।
স্বতঃস্ফূর্ততার নিয়ম মেনে স্রোত বইয়ে দেন অচেনা খাতে। আবার নয়া জনমে জাতিস্মরের
মত ভেসে ওঠে পূর্ব সম্পর্কের ছবি! কখনও অভিমান, কখনও বা কষ্ট জোয়ারের মাথায় নেচে
ওঠে
“একসঙ্গে থাকতে থাকতে একসময়ে সপর্ক ভেঙে পড়ে
কোথাও
এতটুকুও শব্দ হয় না”
ভালোবাসার কাছে সমর্পিত
কবি। অন্তর্মুখী কথামালা যতটুকু শব্দ করে উচ্চারিত হলে ভালোবাসার কথাটুকু বোঝা যায়
ততটুকুই বলেন কবি, বাকি কথা ডুবে থাকে দ্রাবকের স্তব্ধ গহিনেঃ
“খুবই অল্পই বলেছি
জলের উপর যতটুকু
ভেসে থাকে বয়া
সম্পর্কই আদতে একতা জনপদ।
যেমন তার রাজপথ আছে, তেমনই আছে অসংখ্য গলি। সময় বয়ে যেতে যেতে আপন ছন্দে সেই সব পথ
ধরে, দু ধারের দৃশ্যরাজি ঘন ছাপ ফেলে যায়, হয়তো
বা যায় না! কখন যে রাজপথ ছেড়ে প্রাসাদ ছেড়ে কোন গলির শেষ সীমায় কোন কুঁড়েতে
খানিক সময় ভুলে যাবে সময়ের কণারা সে কেউ জানে না! এই সমর্পণে ‘কোনো ধর্ম নেই,
অধর্মও তো নেই কোনও’।
“ মানুষের অনেক বন্ধন
এই সব
বন্ধন কাটাতে পারে না বলে মানুষ আটকে থাকে
ছেঁড়া
পাতার মতন জীবনযাপন করেও
আনন্দে উড়তে পারে না”
জীবন তো চলমান। বহমান।
নির্লিপ্ত শূন্যে কণার মত নির্বিকার ভেসে যাওয়া আদতে। অথচ সেই ভাসন যাপনের
সত্যতাটুকুর অননুধাবনের মেঘ দর্শনপথটাকে আড়াল করে, ভাসনের আনন্দটুকু ছিনে নেয়।
ভাসার অমোঘ সত্যের কথা কখন যেন হারিয়ে যায় কণার হৃদয় থেকে, পড়ে থাকে বাঁধ দিয়ে
গোলা ভরে শস্য ভরে তোলার প্রয়াস। ভাসনের গতি কখন বদলে যায় দৌড়ের পীড়নে।
“এই দৌড়তে দৌড়তে এখন আর আমি চাইলেও পারছি না
থামতে
আমি দৌড়চ্ছি নদীর একটা বাঁক টপকাতে টপকাতে
আমি দৌড়চ্ছি শববাহকেরা শেষরাতে যেভাবে দৌড়য়
আমি দৌড়চ্ছি অফিসের বাস ধরতে যেভাবে দৌড়য় নিরীহ
কেরানি
আমি দৌড়চ্ছি লাল বলের পিছনে যেভাবে দৌড়ে যায় ফিল্ডস্ম্যান
আমি দৌড়চ্ছি
আমি দৌড়চ্ছি
এই দৌড়তে দৌড়তেই দেখছি কখন এসে পড়েছি
এক নির্জন রাস্তায়
সেখানে
এক একাকী গাছ ততোধিক নিঃসঙ্গ বাহুমেলে বলছে
থামো,
থামো, থামতে শেখাটাও তো দরকার”
প্রসঙ্গে আসি। যা লিখছিলাম এতক্ষণ,
তা কবি প্রবাল কুমার বসুর কাব্যগ্রন্থ ‘এই যে আমি চলেছি’ পাঠের পরে চুপ করে খানিক ভাবনার
ফল। কবিতা তো এমনিই চিন্তার জন্ম দেয়। নতুন ভাবে দেখতে শেখায়। সে জন্যেই আজও লোকে কবিতা
পড়ে। এমন বিষম গতি রাক্ষসের কবলে পড়েও মানুষ কবিতা পড়ে, কবিতা লেখে। আগামীতেও বিশ্ব
যতই দৌড়োক সেই পাগলা গণেশের মত কোথাও নির্জনে কেউ না কেউ কবিতার গাছে ফুল ফোটাবেন।
সে ফুলের গন্ধ একবার পেলেই ব্যাস! মনে ঘোর, জুতোয় কাঁকড়! কবি প্রবাল কুমারের কথাই ধরুন-
আদ্যন্ত আধুনিক ইঞ্জিনিয়ার মানুষটি কর্মসূত্রে এদেশ ওদেশ বিদেশ সবখানকে ইতমধ্যে স্বদেশ
বানিয়ে ফেলেছেন। কর্মজগতের বিপুল ব্যস্ততার মধ্যেও কবিতার ঘোর তার নিত্যি লাগে। তাঁর
অক্ষরমালায় তা সুস্পষ্ট ভাবেই তো ধরা পড়ে।
বাংলা সাহিত্যে অন্যতম সম্মানিত এই
কবির অভিজ্ঞতার জারণে যে অক্ষরমালা ভেসে ওঠে আমার মত সাধারণ পাঠকও তাতে দু’ কলম লিখতে
আগ্রহী হয়। অক্ষরের মধ্যে জীবনের পাঠ, থামতে শেখাটাও তো দরকার। যদিও বহমানতাই জীবন,
তবুও সে বয়ে যাওয়া তো নির্লিপ্ত। কিন্তু যে দৌড়ে আমরা চলেছি সে দৌড় যে অন্তিম লগ্নেও
থামতে পারছে না- এমনই তার জাড্য! বরং ভেসে যেতে যেতে ফুরফুরে হাওয়া লাগুক প্রাণে, যে
সৃষ্টিসুখের আনন্দ চিরকালিন কবির কথায়, কবি প্রবাল কুমার বসুর ছত্রে ছত্রেও অন্য আঙ্গিকে
তা মূর্ত!
কবিতা ভালোবাসেন যে পাঠক, ভাবতে ভালোবাসেন
যে পাঠক, দৃশ্যের বহিরঙ্গে নয়, অন্তর্জগতে হাঁটতে ভালোবাসেন যে পাঠক, অকারণ হরষে দোলে
মন যে পাঠকের, তাঁর কাছে এই অক্ষরমালা অনুরণিত হবেই।
-- শাশ্বত কর, শময়িতা, দোলযাত্রা, ২০১৮
Comments
Post a Comment