Skip to main content

এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি


 

 “Poetic Idealization is not a frivolous embellishment, but a profound penetration in virtue of which we pass from troublous emotion to the serenity of contemplation.”                                                                                                                     - Benedetto Croce

মধুমঙ্গল বিশ্বাসেরআরণ্যক খাঁড়িপড়বার পর সবার আগে ইতালীয় দার্শনিক ক্রোচের এই কথাটাই মনে এল কাজেই সেই দিয়েই শুরু করলাম  যদিও কবিতায় জ্ঞানগম্মি আমার কালবোশেখিতে ওড়া ধুলোর মত, তবুও পাঠক তো! সেই জনতা জনার্দনের একজন হয়ে ভালো লাগা অথবা মন্দ লাগার অভিব্যক্তি তো প্রকাশ করাই যেতে পারে
কবি অত্যন্ত সুপরিচিত পাঠক আদৃত বলা যায় কবিকুল আদৃতও অবশ্য যেহেতু আলোচ্য কবি একটি সুপত্রিকার সম্পাদনায় সুদীর্ঘকাল নিযুক্ত, কাজেই কবিকুল বেষ্টনি থেকে অবশ্য তাঁর প্রতি কাব্য লক্ষ্মীর কৃপা খুঁজতে চাওয়া কেবল অনৈতিক নয়, অবৈজ্ঞানিকও বটে

কী আক্কেল বলুন তো, কবিতার বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়ায় আবার কেমনতরো প্রসঙ্গ! ধান ভানতে শিবের গীত! কীসের মাঝে কী/ না পান্তাভাতে ঘি!

আজ্ঞে তা ঠিক নয় যে ভারিক্কি দর্শন আলোচ্য বইটির আনাচে কানাচে, তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতে গেলেও একটু কবিকে জানবার চেষ্টা করা দরকার বলে বোধ হয় অবিশ্যি সে খোঁজ দেবার অবকাশ এটি নয় সুজন পাঠক নিজ আগ্রহে সে কাজটি সমাধা করবেন এটুকুই বলি, সংগ্রামী হৃদয় ( হে পাঠক, আক্ষরিক অর্থেই সংগ্রামি) প্রতি নিয়ত জীবনের যে মোড়ক উন্মোচনের সাক্ষীঃ বেদনার পাশে পাশে অনন্তের অনবদ্য হাসি, পাড়ের ভাঙন আর চড় জেগে ওঠার যে অমোঘ বিস্ময়, ঝরে পরা পাতার পাশে পাশে উদ্ভিন্ন কিশলয়ের গান- সেই অভিযাত্রার অন্তঃজারিত জ্ঞানের প্রতিফলন এইআরণ্যক খাঁড়ি

বইয়ের প্রকাশকাল ২০১৫ অন্তর্ভুক্ত মানিকগুলির রচনাকাল ২০০৮-০৯ উৎসর্গবাবা-কে, নিরক্ষর হয়েও যাঁর অগাধ শিক্ষানুরাগ-মানুষ হওয়ার সাধনায় যাঁর মন্ত্রগুপ্তি সন্ধানী পাঠক, লক্ষ্য করে দেখুন- মানুষ হওয়ার সাধনা বলছেন হাত পা দাঁত নখ সব নিয়েই তো মানুষ আকার নিয়ে জন্মেছি তবু মানুষ হবার সাধনা! সাধনাই তো বটে সাধন বিনে মানুষ হবে না- এই তো অমোঘ বাণী যুগ যুগান্তের সাধনা- মানুষ আকার পেয়ে মানুষ হবার, আপনাকে চেনার- আত্মজ্ঞানের সাধনা

চল্লিশটি কবিতার এই সংকলনের প্রায় অলিন্দে অলিন্দে সেই সাধনার সন্ধ্যাবাতি, শঙ্খধ্বনি বই আলোচনার নয় নিবিড়পাঠের পাঠান্তে অনুধাবনের, নিদিধ্যাসনের

শুধু যাওয়া আসা/ শুধু স্রোতে ভাসাঃ
   কী বলি, কবিতা পড়তে পড়তে মনে রবীন্দ্রনাথের গানখানা ভাসে উপনিষদের স্তোত্র কানে ভেসে আসেপূর্ণাৎ পূর্ণম উদচ্যতে’- পূর্ণ থেকে পূর্ণ গ্রহণ করেও পূর্ণই অবশিষ্ট থেকে যায় কোনো শেষ নেই নেই কোনো শুরু অবশ্য চর্মচক্ষে যে শেষ বা শুরু, সেও যে আপেক্ষিক পরম নয় চরম নয় কেবলই আপাত এই তো বিজ্ঞান বিজ্ঞানকে অতিক্রম করবে কে? তবে বিজ্ঞানকেও তো চিনতে হয়, ছাই এর আস্তরণের আবডালে কোথায় ছুপে আছে অনন্তের সর্বস্ব আগুন, দিনের আবডালে কোথায় মিলিয়ে আছে স্বপ্রভ নক্ষত্রমালা সে তো খুঁজে নিতে হয় সেই তো সাধনা কবি সে সাধনা করেন একান্তে সাধনা করেন সাধনার জন্যে গিরিরাজ হিমালয় নিষ্প্রয়োজন কবিমাত্রেই জানেন বহুত্বের ভিড়ে একলা হয়ে যেতে মনই তাঁর সাধনক্ষেত্র নয় দরোজা তাঁর বার্তাবাহী দরজা থেকে আসা রসদে কবি অন্তরে বসে পাক করেন জারণ লব্ধ জ্ঞান শব্দের আকারে লেখা হয়ে থাকে কাগজে চিদাকাশে যে অপূর্ব বোধোদয়, তার মায়ালু আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে কবিতার খাতা পাঠকের মনোবীণা যদি সেই কম্পাঙ্কে মেলে তবে অনুরণিত হয় সুর হেসে ওঠেন নাদ ব্রহ্ম
বললাম না, কেবল আপেক্ষিকতা, কেবল যাওয়া আসার স্রোত! পড়ে দেখুনঃ
তবু যে নিভৃতজন, লজ্জারুণ, ঘুলঘুলি দিয়ে মিহি ফিনফিনে
যেন ফড়িংডানার তুচ্ছ কেঁপে ওঠা পৌঁছে দেয়
যেন রিংটোন, যেন ধাতবগাত্রের মিহি নিকেলের ছোঁয়া
এই আছে এই নেই, যেন পদ্মপাতায় জল
আশা      (একতারায় বসন্ত , পৃঃ )
রোমান গাথায় ঈশ্বর জেনাসের দুটি মুখ- এক মুখ প্রসারিত অতীতে, আর এক মুখ তাকিয়ে ভবিষ্যতে এই তো নিয়ম জীবনের, এই তো বেঁচে থাকার সুর আরণ্যক খাড়ির কবি লেখেনঃ
প্রাচীন মদের দিকে চেয়ে থাকি
নতুন পাত্রের দিকে চেয়ে থাকি
নুতুন পাত্রের বুকে হেসে উঠবে সময় যে পাতা ঝরে গেল, উড়ে যেতে যেতে কচি সবুজটির গালে আদরের চুম এঁকে যাবে, যে মেঘের জল ঝরে গেল সাগরের তলে মিশে যেতে যেতে সে নবাঙ্কুর মেঘকে শোনাবে রূপকথার গান- এই তো নিয়ম এর অন্যথা কোথায়?


আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজঃ

আমারই চেতনা সে আমাকে বলে দেয় এই তোমার পথ তো সুন্দর আমি সুন্দর দেখতে দেখতে হাঁটি চেতনা বলে, না না! পথ তোমার নয়, যে অসুন্দর, এখানে কালো ধোঁয়া...বিষ! আমার গলা বুজে আসে, ঘাড় নুয়ে পড়ে চেতনা বলে, দেখো সূর্য উঠেছেন দেখি আলোয় ভরে উঠেছে চরাচর সবুজের গালিচায় ফুলের আভা,পাখির গান মূর্ত হয়ে ওঠে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, “তোদের চৈতন্য হোক”! কবি গান, “মার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী”! চেতনার চৈতন্যে উত্তরণ! বড় কঠিন সাধনা চেতনার নাগাল পাওয়াই কি সহজ? জনায় পায়? যে পায় সে লেখেঃ
প্রথম বর্ষার কাদা মনে হল নবনী নবনী
এই খর পদ, যাকে পা বললে লাগসই
রাধা রাধা হয়ে উঠল
অথবাআঁধার অমেয় হলে/ সকলই বৃন্দাবন
চেতনাই মানুষকে স্বতন্ত্র করে চেতনা মেপে মানুষ সেজে ওঠেন আত্মজ্ঞানএর দর্শন হলে মানুষ সর্বব্যেপে একজনকেই দেখতে পান অনন্ত নিরন্তর শক্তির প্রবাহ তাঁর সামনে জেগে ওঠে কেবলই প্রবাহ সেখানে কোনো বন্ধন নেই যেটুকু বন্ধন বলে বোধ হয়, সে তো আপাত...মায়া প্রবাহ ক্ষেত্রপ্রভাবে কোথাও মানুষ, কোথাও নদী, কোথাও হিমশৈল পর্বত কীসের দুঃখ, কীসের শোক! কেবল চলার আনন্দ! মেঘ কি জল জন্মে ফুরিয়ে যাওয়ার দুঃখে মুহ্যমান হয়? হবেই বা কেন? জল থেকে যে মেঘবালিকার নতুন জনম এই তো চক্র এই চাকাই যে চরাচরের একান্ত আপন বৈশিষ্ট্য জগতের যত ঘটনা তার সব নির্ধারিত আপন আপন চক্রে এমন কীচক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি দুখানি ’- সুখ দুঃখও চাকা মেনে নামে ওঠে, দিন রাত্তির থেকে জন্ম মৃত্যু- সব চাকা মেনেঃ নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে! প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করি মধুমঙ্গলের কাব্যভাষাঃ

আমরা তো প্রতিদিন দেখি শুকনো পাতাকে ত্যাগ করে
বৃক্ষ; আর ঝরাপাতা পতনের শোক মনে না মেখে উড়ে চলে,
কেবল মানুষই দিন দিন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে...



আছে জন্ম আছে মৃত্যুঃ

Our birth is about a sleep and a forgetting; the soul that rises with us, our life’s star, Hath had elsewhere its setting, And cometh from after” –William Wordsworth
এ কথাখানা যতবার পড়ি কানে বেজে ওঠে শ্রীমৎ ভগবৎ গীতার সুরঃ “ বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়..” জীর্ণ পোশাকের বদল বৈকি তো কিছু নয়। সত্যিই তো। তবে কিসের লেগে হানাহানি, আকচা আকচি! এটা আমার, ওটা তোমার এর ব্যবধান! কীসের যুদ্ধ? কীসের লড়াই? কীসের বিভেদ? কোনো বৈষম্য তো আদতে নেই, আদিতে নেই। তবে মধ্যে কেন? অন্ত বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেখানেও তো থাকার কথা নয়।
এই স্টেশন থেকে ছেড়ে গেল মেট্রো রেল। ঝলমলে আলো ছেড়ে ঢুকে পড়ল অন্ধকার গুহায়, সুড়ঙ্গে। তবে কি শেষ? কই তা তো নয়। ওই তো আঁধারের শেষে ঝলমল করছে নতুন স্টেশন। কবির ভাবনায় জীবনও তো এ ব্যতিরেকে আর কিছু নয়। নয়া জনম যেন ঘুম ভেঙে ওঠা আরেক জীবনে। মৃত্যুও তো শেষ নয়, সে যেন সংবাহী নালিকা- এক জনম থেকে আরেক জনমে। এ ভাবেই তো যুগ যুগান্ত ধরে ভেবে এসেছেন কবি। কবির সংস্কার প্রবাহিত হয়েছে এক জনু থেকে অন্য জনুতে, যেমনি করে জল বয়ে যায় এক মেঘ থেকে অন্য মেঘে।
কবি মধুমঙ্গল তাঁর এ বইতে পাতাকে ব্যবহার করেছেন বহুমাত্রায়। কখনও পাতা জীবনের দ্যোতকঃ

‘নির্ঘন্ট না মেনেই যার আসা/ তাকে ঝরাপাতা, বসন্তের অভিক্ষেপ বলা যায়’ অথবা, ‘বিরহ যাপিত হল পাতার পোশাকে’। আবার ‘অসুখ নেমে এল পাতার কুটিরে’ নয়তো, ‘পাতার এ দিনযাপন সমগ্রের প্রতিভাস’।

কবি তো প্রকৃতির প্রিয়তম সন্তান। প্রকৃতির টান কবির কাছে মায়ের নাড়ির। নাগরিক কবিও নিজের অজান্তে চলে যান প্রকৃতির অনুসঙ্গে। যেখানে মায়াময় ঘাস। মায়ামেদুর টিলার কোলে নতুন জনপদ। বিভূতিভূষণ, লবটুলিয়া বইহার। কবির মানসভ্রমণ সেখানে চন্দ্রাতুর রাতেঃ “ সেখানে জ্যোৎস্নার ডানা মিহি মসলিন, সে ডাক উপেক্ষা করি স্পর্ধা কোথায়!” কে উপেক্ষা করবেন? কোনো কবি পেরেছেন সে ডাক উপেক্ষা করতে? ডাক পেলে হাঁটতেই হবে পথে, দুই চোখে ভরতেই হবে মায়াময় নেশা..খাড়ির অসহ্য টানে আরণ্যক হতেই হবে কবিকে।


হরিপদ কেরানির সাথে আকবর বাদশার কোনো তফাত নেইঃ

কিনু গোয়ালার গলি তো কেবল একখানে নয় সর্বত্র বনফুল লিখেছিলেন, গাছের ডাল হাতে বুড়ি আমাদের দেশে অনেক আছে সত্যিই কেবল বাইরের মোড়কটুকু আলাদা সেটুকু অন্তর্চক্ষে উন্মোচন করতে জানলেই দেখা যাবে সমাজে সর্বত্র হরিপদ কেরানি কপালের ঘাম ঝাড়ছেন, বাজার আনছেন, দুধ আনছেন, আপিস যাচ্ছেন, ঝগড়া, খুনসুট্খুসকি, উকু্- সবখানে বিচরণ আর আকবর বাদশাও আছেন পোশাক কেবল ভিন্ন চিনে যদি নিতে পারেন দেখবেন ঠিক বোঝা যাবে রোয়াবের শাহি ঝাঁঝ! কিন্তু এখনও কেন এই বৈষম্য? কেন অসাম্য? প্রকৃতি তো তাঁর দানে কার্পণ্য করেন না, অসাম্য দেখান না তবে অসাম্যের ধারক বাহক এরা কারা? সৃষ্টির এত পরেও এখনও মানুষ কেন পেল না মানব জনম? কবি লেখেন, “ আমি তাকে প্রতিদিন দেখি, চল্লিশ অথবা চারশো বছর/ মানুষের মনে তবু জ্বলেনি তো আলো অথচ সেই কবে পুরাণ, কোরানে সাম্যের সুর বেজে উঠেছে, আত্মজ্ঞানের আশ্রয় টুকু খুঁজে নেবার দীপখানা জ্বেলে রেখেছে..জনায় খোঁজে! আপেক্ষিক জগতের সবকিছু, কেবল যে বহতার ধ্বনিটুকু সার সে কে বোঝায় আর কে বা বোঝে? মধুমঙ্গল লেখেন, “ঝরা দিন আর ঝরা পাতা, আমি তাকে জীবনের সামগীত বলি সামগীতের সেই অনাদি সুরের প্রবাহে লীন হন আকবর বাদশা আর হরিপদ কেরানি আর তাঁদের কাউকেই আলাদা করা তো যায় না! তবে বাদশারই বা কীসের গুমর আর কেরানিরই বা কীসের আক্ষেপ? যে পারাপারের খেয়া আপন খেয়ালে আলেক সাগরে কেবল আসে যায় ভাসে তার যাত্রী হওয়াটাই তো অমোঘ, সে খেয়ায় চড়াও নিজের খেয়ালে নয় আবার কাজ শেষে ফেরত আসাও নিজের খেয়ালে নয় তাইতো পারানির কড়িটুকুও লাগে না যদি লাগেই না তবে কীসের সঞ্চয়? আর ধুলোবালি সঞ্চয় হল না বলে দুঃখই বা কীসের? প্রসঙ্গত উল্লেখ করিঃনির্জন দাঁড়িয়ে থাকি নদীর এপারে/ দেখি, পারাপার চলে, পারাপার.../ অনন্ত খেয়ায়..” এই পারাপারের সাক্ষী হয়ে থেকে কবি অশ্রু লেখেন সনাতন অশ্রুনিয়তির বার্তাবহ অশ্রুকুসুম কবি দেখেন যুগযুগান্তের ধারাপ্রবাহে ভাসে সোনালি পারানি, কবি সেই স্বপ্রভ আলোকবর্তিকাকে দেখে ভাবেনঃসে কি কোনও ঘন অরণ্যের সাবেক জোনাকি”? তারপরেই কবির অতল থেকে ভেসে ওঠে সাম্যগীতির ইচ্ছাটুকু, যে ইচ্ছেয় মুছে যেতে চায় হরিপদ কেরানির খেদ আর বাদশাহী গুমরের ক্লেদঃদীনজনে আলো দেয়, অন্ধজনে চাপার সৌরভ সীমান্তের বৈষম্য গন্ডী ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে চায় কবির মননেঃতারকাঁটা তছনছ হতে চায়, সীমান্তে/ ভীষণ সুনামি হবে...” তারপরতার গোপন গোপনতমে বিশ্বাস/ রেখেকবি চলে যানবিপ্রতীপ ভাবনার দেশে নিবিড় বিষাদের ধ্যান লব্ধ ভাবনায় লেখেন অশ্রুলিখনঃকিছুই হচ্ছে না আজ, সরলরেখাবরাবর/ আলোর ধেনুরা সব বেঁকে যাচ্ছে অন্য সরোবরে

ওরে বিহান হল জাগোরে ভাইঃ

একদম শুরুতেই স্বীকার করেছি কবিতার আলোচনার আমি কেউ নই তাবড় তাবড় কবি আছেন, পণ্ডিত আছেন, দাড়ি আছে সেখানে হাত বুলিয়ে কর গুণে তাঁরা বলতেই পারেনসাত দু গুণে কত হয়?” না বাপু আমার পক্ষে উত্তর দেওয়া অসম্ভব না জানি ছন্দ, না জানি মাত্রা না জানি লয় তবে জানোটা কী হে? আজ্ঞে দেখতে জানি, দেখে একবার সুন্দর বলে বলতে জানি, সেই সুন্দরের রেশটুকু ভোরের বেলায় ঘাসের ডগের জলে মেশাতে জানি তার মানে মোদ্দা কথাটি হল, ভাইটি আদতে তুমি কাব্যি কবিতার জানো না
নাই জানলাম সে তো অপরাধের নয় ছন্দ ছাড়া যে জগতের একটি পাতাও হিলে না, একটি মাছও নড়ে না, একটি সারসও ওড়ে না- সে তো সত্য সেই সত্যেরই তো সন্ধান করেন সাধক সে সাধক কখনো আপনভোলা বৈজ্ঞানিক তো কখনও আলাভোলা কবি আপাতত সেই সত্যের ছোঁয়াচ কবি মধুমঙ্গলেরআরণ্যক খাঁড়ি পরতে পরতে সেই সত্য আমায় ভাবিয়েছে বেশ কিছু কবিতা পাঠে গজলের খুশবু পেয়েছি মুগ্ধতা নয় চিন্তনের খোরাকের জোগান দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দেওয়ার আগে সম্পূর্ণ বইয়ের পাঠে যে কয়টি দ্বন্দ্ব আমার সামনে উঠে এসেছে সেগুলি একবার বলে ছালা গুটোইঃ

স্মৃতি বনাম বর্তমান, জীবাত্মা বনাম পরমাত্মা, প্রকৃতি বনাম কৃত্রিমতা, ভোগ বনাম ত্যাগ, স্থূল চেতন বনাম সূক্ষ্ম মোক্ষভাব অথবা বোধি, প্রেম বনাম শরীর, ব্যক্তি বনাম ব্যষ্টি-এই দ্বন্দ্বগুলোর উত্থাপন, বিস্তার এবং উত্তরণ কবিতা পাঠে আমায় ভাবিয়েছে কোন কবিতার অনুষঙ্গে কোন দ্বন্দ্ব পেলুম তা বলবার দায় আমার নয়, বরং খোঁজবার দায় মরমী পাঠকের অতএব হে পাঠক পড়ুন বিহানবেলার ঘুম ভাঙানিয়া সুর হয়তো শুনতে পেতেও পারেন


ঋণস্বীকারঃ উপনিষদের সুরগুলি যাঁর অক্ষরে অক্ষরে বাজে সেই প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী রবীন্দ্রনাথের কাছে               চিরঋণী এখানেও তাঁর পংক্তি ব্যবহার করায় ফের ঋণস্বীকার করলাম




শাশ্বত কর, শময়িতা, ২১শে মার্চ,২০১৮

Comments

Popular posts from this blog

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যাচ্ছেন কি? যাচ্ছেন কোথায়? লাখ টাকার প্রশ্ন! বিজ্ঞানের এক উত্তর, শিশু ভোলানাথের এক উত্তর, গোঁয়ার গোবিন্দর এক উত্তর, বোদ্ধার এক উত্তর! ঘন রহস্য! অথবা কোনোই রহস্য নেই। কৃষ্ণ কেমন, না যার মন যেমন। জলে হাওয়ায় গেলাস ভরা ভাবলে ভরা, আধখানা খালি ভাবলে খালি। আসল কথাটা হলো আজ বছরের শেষ সন্ধ্যে। আজ হেব্বি সেলিব্রেশন! কোথাও জামাল কুদু, কোথাও লুটপুট গয়া তো   কোথাও দিন হ্যায় সানি সানি সানি-   চারপাশ থেকে নানা রকমের গান ভেসে আসছে। একের সুরে আরেক চেপে বসায় কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না মনে। এমনটাও ভালো। এতেও এক ধরণের নির্লিপ্তি আসে। নির্লিপ্তিই তো মুখ্য, নির্লিপ্তিই মোক্ষ। আজ ভর দুপুরে ছাদে গিয়ে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছপালাগুলোর একটু পরিচর্যা করলাম। খালি দুটো টবে দুটো বীজ পুঁতলাম। একটা উচ্ছের  আর একটা ঢেঁড়সের । এই দুটোই আসলে আজকের বর্ষ শেষের আমি। কাজের দুনিয়ায় যেমন তেঁতো, ঘরের দুনিয়ায় তেমনি ঢেঁড়স। তো দুই আমিকে বছর শেষে দিলাম পুঁতে। নতুন ভোরে খোলস ছেড়ে বেরি

অসুস্থ সমাজ, অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং নিছক সাধারণী আবেদন

  ডাক্তারদের অনশন আজ ১০ দিনে পড়ল । পাঁচই অক্টোবর থেকে আমরণ অনশনে বসেছেন। প্রথমে ছ'জন পরে আরো একজন , উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে আরও দু'জন জুনিয়র ডাক্তার আমরণ অনশনে বসেছেন। বলছি বটে জুনিয়র, কিন্তু যে পর্যায়ের পরিণত মনোভাব এঁরা দেখিয়েছেন এবং দেখাচ্ছেন চিকিৎসা পরিভাষায় যাই হোক, মানবতার পরিভাষায় এরা সিনিয়রস্য সিনিয়র।  অনশন। কেবল জল। আর কিছু নয় । বলাই সহজ, কাজে মোটেই সহজ নয়। একবার রাগ করে না খেয়ে একবেলা ছিলাম। আর মনে পড়ে আর একবার মায়ের সাথে উপোস করেছিলাম কোজাগরি পূর্ণিমায়। দুবারই সন্ধ্যে হতে না হতেই হাটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগেছিল। আর টানা 10 দিন অভুক্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা! এখনো চলছে তাঁদের অনশন ব্রত।  শারীরিক সমস্যা জয় করতে হচ্ছে। জনমানসের আশা প্রত্যাশার পাহাড় জয় করতে হচ্ছে। মানসিক চাপ জয় করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের চাপ। সহজ কথা তো নয়। তাও জয় করতে হচ্ছে। অকথা কুকথাকে খড়কুটোর মত ছুঁড়ে ফেলে পাখির চোখে চোখ রাখতে হচ্ছে। কেন করছেন তারা অনশন? রাজ্যে গত নয়-ই অগস্ট নারকীয় ঘটনা ঘটে গেছে আর জি কর মেডিকেল কলেজে। তাদেরই সহকর্মী দিদি অথবা বোনের নৃশংস পরিণতি তাঁদের মুঠো শক্ত করেছে। চ

এসো মা, এসো মা উমা

 শাশ্বত কর সুপ্তপর্ব “যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে! গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!” ঠাকুর দালানে ধুনুচি সাজানো হচ্ছে। এও এক শিল্প! নারকেলের ছোবড়া উল্টো করে এমন করে সাজা হবে যে ধুনুচি নিম্নমুখী হলেও সহজে পড়বে না! নইলে আরতি জমবে কেমন করে!  ছোবড়া চুঁইয়ে ধোঁয়া মিশছে বাতাসে। বাতাসে ধুনোর গন্ধ! বাতাসে কর্পুরের গন্ধ! বাতাসে শিউলি, ছাতিম, বাতাবি ফুলের গন্ধ! বাতাসে ঠান্ডা আদর! আদর আমার গালে। মায়া আদর, আচ্ছন্ন আদর। যে সুগন্ধী বাতাস নাকি গোলাপের মৃদু পাঁপড়ি এই আদর এঁকে গেল, এই তো খানিক আগে যখন তেতলার চক বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচে ঠাকুরদালানের পাশে রাঙাপিসিমাদের আড্ডা দেখছিলাম, তার নাম এখানে লেখার কীই বা দরকার? গতকাল সকালে পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা সেই আমায় দিয়েছে, ভিড়ের অছিলায় আঙুল ছুঁয়ে গেছে। কাছে আসলেই মায়ের পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা আমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক পুব বাগানের বাঁধানো বেদির পাশে রাত আলো করে থাকা নিশিপদ্মের মতো! এ গন্ধের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা! এখন যেমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি চক বারান্দায়। হাতে শ্রীশঙ্খ! ঠাকুর তোরঙ্গ থেকে বড় শাঁখখানা আনতে পাঠিয়েছিলেন র