Skip to main content

জগুমামা, টুকলু আর চলমান সমাজ





ই গল্পটা শুনেছিলাম বাবার কাছে। প্রচলিত গল্পই। তবু কথামুখ হিসেবে অবশ্যই খাটে। কাজেই উল্লেখ করে ফেলিঃ

     দুই ভাই। বড় জন শান্ত শিষ্ট। ছোট জন স্বাভাবিক সাম্য রক্ষার্থে যাকে বলে পেল্লায় ন্যাজ বিশিষ্ট। প্রথম জন গুছিয়ে কাজ কম্ম করেন, দ্বিতীয় জন গুছোনো জিনিস এলোমেলো করেন। তবে ভায়ে ভায়ে বেজায় ভাব। তাদের পড়ানোর জন্য এলেন এক গৃহ শিক্ষক। তাঁর চেষ্টার তো কোণো ত্রুটি নেই। তবু শিক্ষা ঠিক আশাপ্রদ হয় না। বড় জন তেমন বুঝতে পারে না। আর ছোটজন তো পড়েই না। তখন শিক্ষক মশাইয়ের মনে হলো- নাঃ! এ ভাবে ভবি ভুলবে না। বরং কায়দা করে শেখাতে হবে। প্রকৃতির মাঝে টেনে নিয়ে কাজের আনন্দে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। দুই ভাইকে নিয়ে শিক্ষক এলেন উঠোনে। উঠোনে ভরন্ত কুল গাছ। শিক্ষক গাছ ঝাঁকালেন। টোপা কুল টপটপিয়ে পড়ল। শিক্ষক বললেন, গুণে গুণে কুল তোলা যাক। বড় ভাই গোণে। ছোটো ভাইও গোণেঃ এক, দুই, তিন...ওই দাদা! মাস্টামশাই আঁক করাচ্ছে রে! কুল খেয়ে আর কাজ নাই! পালা পালা!

চেনা গপ্প। জানা কথা। কিন্তু একটা শিক্ষা আছে। সেটি হলো, ছোটদের কিছু শেখানোর কাজটা মোটেই ছোটখাটো নয়। বরং মারাত্মক কঠিন। যদি বিশ্বাস না হয়, কাছাকাছি যে কোনো কিন্ডারগার্টেন স্কুলে গিয়ে দেখুন। যে কোনো শিক্ষিকার সাথে কথা বলুন- সত্যিটা মালুম হয়ে যাবে। এক এক জন বাচ্চা আসলে এক এক জন জিনিয়াস! মারাত্মক সব ভাবনা! কল্পনা যে কোন দিকে দৌড়োবে কেউ জানে না।

এই জিনিয়াসরাই আরও একটু বড় হবে। হাতে পায়ে হয় তো খানিক শান্ত হবে, কিন্তু উপরের স্থির জল দেখে মোটেই মালুম করা যাবে না ভিতরে কী স্রোত বইছে। এদের শেখানো তো আরও কঠিন কাজ।

অথচ এমন কঠিন কাজ বেশ সহজেই করে গেছেন আমাদের অগ্রজ সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীরা। আমাদের এই সময় তো আরও সরেস। হাতে হাতে গুগল! ভূতের গপ্প বলতে গেলেও এখনকার ক্ষুদেরা বলে, কী গো সেই ক্লাসিক ভূত! সেই একই প্যাটার্ণ! সেই বিশ্বজ্ঞানী ক্ষুদে জেনারেশানকে গপ্পের ধাঁচায় বলতে গেলে যে কতটা স্মার্ট কথক হতে হয় তা দেখিয়ে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জগুমামা, টুকলু, অনন্ত সরখেল বহু কিশোরের সাথের সাথি। বলা ভালো সব বয়সী কিশোরদের কাছের মানুষ। কাজেই বিজ্ঞানী জগবন্ধু, মানে আমাদের জগুমামা অথবা টুকলুর কথা খুব বেশি বিস্তারে বলবার প্রয়োজন পরে না!

শ্রী চট্টোপাধ্যায় অদ্ভুত মুন্সীয়ানায় রহস্য রোমাঞ্চের পাত্রে কিশোরদের পাঠ দেন। তবে তলিয়ে না দেখলে বুঝবার উপায় নেই। অনন্ত সরখেলের কান্ড কারখানায় হাসতে হাসতে অথবা খুন রহস্যের জট ছাড়াতে ছাড়াতে কখন যে সমাজ সম্পর্কে, ইতিহাস সম্পর্কে, সংস্কৃতি সম্পর্কে, ঐতিহ্য সম্পর্কে এমন কী রবীন্দ্র নাথের গান নিয়েও কিশোর হৃদয়ে তথ্য ইনজেক্ট লেখক সে মালুম হতে হতে গপ্প শেষ। কী অদ্ভুত বুনট! কী টানটান নির্মেদ কাহিনি! প্রত্যেকটা কাহিনি ইউনিক। আর প্রত্যেকটা কাহিনির শেষে পাঠক কিশোর ধারণা পেয়ে যাবেন এয়ার প্লেনে চড়বার ধাপগুলো, সতর্কতার বিষয়গুলো, কাহিনির পটভূমিকার ইতিহাসের সংস্কৃতির।

উদাহরণ দিই। সিপাহীজলার বিষাক্ত রাত। কিশোর ভারতী, শারদীয়া ১৪১৮ তে প্রকাশিত। কী অনায়াস বিন্যাসে ত্রিপুরার সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, সর্বোপরি ইতিহাস বলে দেওয়া। এমন ভাবে বলা, যে আর একটু জানার জন্য মনে আগ্রহ জাগতে বাধ্য। প্রসঙ্গত অধ্যাপক পি.সি.রক্ষিতের কথা মনে পড়ছে। শুনেছিলাম আমাদের ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড.মিহির মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। উনি শুনেছিলেন ওঁর শিক্ষকের কাছ থেকে। ঘটনা হয়েছে কী, প্রফেসর রক্ষিত তাঁর শিক্ষার্থীদের কথা প্রসঙ্গে এক দিন শিক্ষকের ভূমিকা সম্পর্কে বলছিলেন, শিক্ষকের কাজ কী জানো? ধরো, ওই ঘরের কোণে গিয়ে এই যে কোনো একটা শিশির ঢাকনা যদি আমি খুলি, গন্ধ বেরোবে। গন্ধটা পেয়েই তোমাদের জানতে ইচ্ছে করবে, গন্ধটা কীসের? অয়েল অফ উইন্টার গ্রিন, না কি আসিটোন? শিক্ষকের কাজ কেবল ওই কৌতুহলটুকু জাগানো। কৌতুহল হলে তুমি তো আপনিই জেনে নেবে সত্যিটা কী। সেই তো প্রকৃত শিক্ষা তোমার।

শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের জগুমামার গল্প পড়ে আমার তো কৌতুহল জাগে। মনে হয়, যে নতুন বইগুলোর নাম এখানে জানলাম পড়তে হবে। যে ইতিহাসটা খানিক জানলাম সেটা আরও একটু জানতে হবে। যে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো গপ্পে বাজল, সত্যি বলছি, গপ্প শেষ হওয়ার পরেই শুনতে ইচ্ছে জাগে।

শ্রী চট্টোপাধ্যায় তাঁর গল্পে পাঠককে পুতুপুতু করে রাখেন না। বরং তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। অকারণ রঙিন চশমায় মন না ঢেকে জগুমামার সংলাপে, কার্যকলাপে আমার ভারতের তো বটেই, ভারতের বাইরের অশান্ত অবস্থাটাও চিত্রিত হয়। সিপাহী জলার বিষাক্ত রাতে যেমন আলফা জঙ্গীদের কার্যকলাপ, তাদের গতিপ্রকৃত, বাড় বাড়ন্তের কারণ- সব চিত্রিত হয়েছে কিশোরদের মত করে। ছোট হোক বয়সে, তবু মানুষ তো, দেশের মানুষ তো! কাজেই সে কেন জানবে না তার মত করে দেশের সমস্যাগুলো! আসলে তো ‘we are on the same boat brother’! কাজেই কেবল রূপ কাহিনির আড়ালে তাকে রাখব কেন? এই ভাবনা যাঁর গল্পে গল্পে ধ্বনিত হয় তাঁকে কুর্নিশ!

আরেকটা কথা বলতেই হবে। সংলাপ। একেবারে কথ্য মার্জিত ভাষার সংলাপ হচ্ছে জগুমামা-টুকলুর কাহিনিগুলোর সম্পদ। ইঞ্জিন বললেও বোধ করি ভুল হবে না। নিবিড় পাঠে প্রতিটা চরিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠেন চোখের সামনে। কী ভাবে সেই চরিত্র রিয়াক্ট করবে পড়তে পড়তে পাঠকের সে নিয়ে প্রত্যাশা তৈরি হয়ে যায়। একেবারে চলচ্চিত্রের মত গোটা ঘটনাক্রম চোখের সামনে ভাসে পড়বার সময়।

কাজেই এমন কাহিনির ট্রেন চলতেই থাকুক, চলতেই থাকুক-যাত্রী হিসেবে আমার তো অন্তত সেটুকুই প্রার্থনা। জগুমামা, টুকলু, অনন্তবাবু একের পর এক ভেদ করে চলুন রহস্য আর গপ্প পড়তে পড়তে অজান্তেই ঋদ্ধ হই আমরা। নিশ্চিন্তে জগুমামার সমস্ত ভক্ত-ভক্তাদের এটাই মনের কথা।




শাশ্বত কর, শময়িতা, ২৪শে মার্চ, ২০১৮


Comments

Popular posts from this blog

গৃহপ্রবেশ- ভালোবাসার ঘর দুয়ার

 শাশ্বত কর  গরম কোন পর্যায়ে সে তো আর বলা না বলার ধার ধরে না। ঘামে ঘামে বাসে ট্রামে সবাই টের পাচ্ছে। একটা কাজে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ করে ঘণ্টা চারেকের অবসর পেয়ে গেলাম। অবসর বটে কিন্তু চাআআর ঘণ্টা এই তুমুল রোদে করি কী? সময় বদলেছে। এমন প্রখর দাবদাহে পথিক কি খুঁজতেন? খানিক গাছের ছায়া, তৃষ্ণার জল- এই তো!  আমার কাঁধের ব্যাগে জল, নাকের ডগায় মাস্ক, মাথায় কপালে রোদ্দুরের তেজে গলন্ত স্বেদ। মাথা চিড়বিড় করছে, পেতে ছুঁচো না হোক কেউ তো ডন দিচ্ছে। এই তুমুল আলোয় সত্যি সত্যি চোখে ঝিলমিল লেগে যাচেছ। সামনে অজস্র খাবারের দোকান, চায়ের দোকান। সেসব ছেড়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসে খোলা মাঠ দেখে সময় কাটাব ভাবছিলাম। চোখে মুখে রোদেল হাওয়ার কঠিন চুম্বনএর ঠেলায় সইলো না! বেরিয়ে এলাম। দক্ষিণ কলকাতার ফুটপাথ। গাছের ছায়ার অভাব নেই, অভাব নেই রোদের দীর্ঘশ্বাসেরও! খানিক উদভ্রান্ত পায়চারির মধ্যেই মরূদ্যানের মত একটা সিনেমা হল। আর পায় কে? টিকেট উইন্ডোতে টিকিটের দাম দেখে খানিক আশ্বস্ত হলাম। এখনো ১১২ টাকায় সিনেমা দেখা যেতে পারে !এই দুপুর রোদে ১১২ টাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসার আরাম। এই ভয়ঙ্কর আশ্র...

যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধ !

  স ত্যিই যুদ্ধ। যুদ্ধ বলে যুদ্ধ! চোখের সামনে যুদ্ধ, নায়কে খলনায়কে যুদ্ধ, দেশে দেশে যুদ্ধ, গানে Gun-এ যুদ্ধ, কানে কানে যুদ্ধ, মনে মনে যুদ্ধ। ধিম ধুম ধাসুম গুদুম গাদুম - বোম পড়ছে, গ্রেনেড পড়ছে , বাড়ি উড়ছে, গাড়ি উল্টচ্ছে, গাড়ি গুঁতোচ্ছে , হেলিকপ্টার উড়ছে, জেট উড়ছে, জেড নিরাপত্তা বুড়ো আঙুল দেখছে, আঙুল চুষতে চুষতে চোর ঠেঙান ঠেঙাচ্ছে হিরো - সব কুছ আরামসে! আরি বাপরি বাপরি বাপ! ওয়ান ম্যান আর্মি - আরি বাপরি বাপরি বাপ!  পুরো বিনোদনের ক্যাপসুল! ক্যাপসুলে কি নেই? তিন ঘন্টার মধ্যে জগত দর্শন! ওরে বাপরে মার কাকে বলে? অবশ্য শুধু মার বললে ভুল হবে। প্রেমের জোয়ার আছে, প্রেমের জোয়ারে দোহার ভেসে যাওয়া আছে। স্পাই ভার্স বলে কথা- কাজেই সুন্দরী নায়িকার স্বল্প বসনে হাঁটাচলার আবেদন আছে, মনে ঢেউ তোলা নাচন আছে। আর সর্বোপরি- গ্রিক গড হৃত্বিক রোশনের নাচ আছে! আর কি চাই? দীপিকা?  পুরো ছবিটাতেই তো হৃতিক রোশন আর হৃতিক রোশন! অবশ্য এন. টি. আর. তাঁর কামাল দেখিয়েছেন। হৃতিকের পাশে নাচার সময় চোখে পড়ে এমন মানুষ বলিউডে এখনও খুব কমই আছেন। এন. টি. আর তাদের একজন। ছবিতে হৃতিকের সাথে প্রায় সমান...

'তুমি তার সেবা কর সুখে'

‘তুমি তার সেবা করো সুখে’ শাশ্বত কর