এই গল্পটা শুনেছিলাম বাবার কাছে। প্রচলিত
গল্পই। তবু কথামুখ হিসেবে অবশ্যই খাটে। কাজেই উল্লেখ করে ফেলিঃ

চেনা গপ্প। জানা কথা। কিন্তু একটা শিক্ষা
আছে। সেটি হলো, ছোটদের কিছু শেখানোর কাজটা মোটেই ছোটখাটো নয়। বরং মারাত্মক কঠিন। যদি
বিশ্বাস না হয়, কাছাকাছি যে কোনো কিন্ডারগার্টেন স্কুলে গিয়ে দেখুন। যে কোনো শিক্ষিকার
সাথে কথা বলুন- সত্যিটা মালুম হয়ে যাবে। এক এক জন বাচ্চা আসলে এক এক জন জিনিয়াস! মারাত্মক
সব ভাবনা! কল্পনা যে কোন দিকে দৌড়োবে কেউ জানে না।
এই জিনিয়াসরাই আরও একটু বড় হবে। হাতে
পায়ে হয় তো খানিক শান্ত হবে, কিন্তু উপরের স্থির জল দেখে মোটেই মালুম করা যাবে না ভিতরে
কী স্রোত বইছে। এদের শেখানো তো আরও কঠিন কাজ।
অথচ এমন কঠিন কাজ বেশ সহজেই করে গেছেন
আমাদের অগ্রজ সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীরা। আমাদের এই সময় তো আরও সরেস। হাতে হাতে গুগল! ভূতের
গপ্প বলতে গেলেও এখনকার ক্ষুদেরা বলে, কী গো সেই ক্লাসিক ভূত! সেই একই প্যাটার্ণ! সেই
বিশ্বজ্ঞানী ক্ষুদে জেনারেশানকে গপ্পের ধাঁচায় বলতে গেলে যে কতটা স্মার্ট কথক হতে হয়
তা দেখিয়ে দিয়েছেন শ্রদ্ধেয় ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জগুমামা, টুকলু, অনন্ত
সরখেল বহু কিশোরের সাথের সাথি। বলা ভালো সব বয়সী কিশোরদের কাছের মানুষ। কাজেই বিজ্ঞানী
জগবন্ধু, মানে আমাদের জগুমামা অথবা টুকলুর কথা খুব বেশি বিস্তারে বলবার প্রয়োজন পরে
না!
শ্রী চট্টোপাধ্যায় অদ্ভুত মুন্সীয়ানায়
রহস্য রোমাঞ্চের পাত্রে কিশোরদের পাঠ দেন। তবে তলিয়ে না দেখলে বুঝবার উপায় নেই। অনন্ত
সরখেলের কান্ড কারখানায় হাসতে হাসতে অথবা খুন রহস্যের জট ছাড়াতে ছাড়াতে কখন যে সমাজ
সম্পর্কে, ইতিহাস সম্পর্কে, সংস্কৃতি সম্পর্কে, ঐতিহ্য সম্পর্কে এমন কী রবীন্দ্র নাথের
গান নিয়েও কিশোর হৃদয়ে তথ্য ইনজেক্ট লেখক সে মালুম হতে হতে গপ্প শেষ। কী অদ্ভুত বুনট!
কী টানটান নির্মেদ কাহিনি! প্রত্যেকটা কাহিনি ইউনিক। আর প্রত্যেকটা কাহিনির শেষে পাঠক
কিশোর ধারণা পেয়ে যাবেন এয়ার প্লেনে চড়বার ধাপগুলো, সতর্কতার বিষয়গুলো, কাহিনির পটভূমিকার
ইতিহাসের সংস্কৃতির।

শ্রী চট্টোপাধ্যায়ের জগুমামার গল্প
পড়ে আমার তো কৌতুহল জাগে। মনে হয়, যে নতুন বইগুলোর নাম এখানে জানলাম পড়তে হবে। যে ইতিহাসটা
খানিক জানলাম সেটা আরও একটু জানতে হবে। যে রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলো গপ্পে বাজল, সত্যি বলছি,
গপ্প শেষ হওয়ার পরেই শুনতে ইচ্ছে জাগে।
শ্রী চট্টোপাধ্যায় তাঁর গল্পে পাঠককে
পুতুপুতু করে রাখেন না। বরং তাকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। অকারণ রঙিন চশমায় মন না ঢেকে
জগুমামার সংলাপে, কার্যকলাপে আমার ভারতের তো বটেই, ভারতের বাইরের অশান্ত অবস্থাটাও
চিত্রিত হয়। সিপাহী জলার বিষাক্ত রাতে যেমন আলফা জঙ্গীদের কার্যকলাপ, তাদের গতিপ্রকৃত,
বাড় বাড়ন্তের কারণ- সব চিত্রিত হয়েছে কিশোরদের মত করে। ছোট হোক বয়সে, তবু মানুষ তো,
দেশের মানুষ তো! কাজেই সে কেন জানবে না তার মত করে দেশের সমস্যাগুলো! আসলে তো ‘we
are on the same boat brother’! কাজেই কেবল রূপ কাহিনির আড়ালে তাকে রাখব কেন? এই ভাবনা যাঁর গল্পে গল্পে ধ্বনিত হয়
তাঁকে কুর্নিশ!
আরেকটা কথা বলতেই হবে। সংলাপ। একেবারে
কথ্য মার্জিত ভাষার সংলাপ হচ্ছে জগুমামা-টুকলুর কাহিনিগুলোর সম্পদ। ইঞ্জিন বললেও বোধ
করি ভুল হবে না। নিবিড় পাঠে প্রতিটা চরিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠেন চোখের সামনে। কী ভাবে সেই
চরিত্র রিয়াক্ট করবে পড়তে পড়তে পাঠকের সে নিয়ে প্রত্যাশা তৈরি হয়ে যায়। একেবারে চলচ্চিত্রের
মত গোটা ঘটনাক্রম চোখের সামনে ভাসে পড়বার সময়।
কাজেই এমন কাহিনির ট্রেন চলতেই থাকুক,
চলতেই থাকুক-যাত্রী হিসেবে আমার তো অন্তত সেটুকুই প্রার্থনা। জগুমামা, টুকলু, অনন্তবাবু
একের পর এক ভেদ করে চলুন রহস্য আর গপ্প পড়তে পড়তে অজান্তেই ঋদ্ধ হই আমরা। নিশ্চিন্তে
জগুমামার সমস্ত ভক্ত-ভক্তাদের এটাই মনের কথা।
শাশ্বত কর, শময়িতা, ২৪শে মার্চ, ২০১৮
Comments
Post a Comment