Skip to main content

মন সাগরের নাইয়া





I will answer you today as I answered you seven months ago: he who enters the Nautilus is destined never to leave again- Captain Nemo

নটিলাস। সাধের নটিলাস। বাইরের চোখ যাঁকে খুঁজে পায় না, অতলের সেই অপার ঐশ্বর্য দু চোখ ভরে দেখে যায় নটিলাস। নির্লিপ্ত অতলে অনায়াস ঘুরে ঘুরে নটিলাস আবিষ্কার করে চলে ‘রোকো দ্য লা প্লাতা, সামুদ্রিক ঘাসের দোল দোল দুলুনি পেরিয়ে অজানা অচেনা প্রবালের দেশ, রাশি রাশি মুক্তো প্রসূতি ঝিনুক উপত্যকা, সাগর তলে নতুন নতুন দ্বীপের জনম।

বিদ্রোহী ভৃগু ক্যাপ্টেন নেমো। অত্যাচারে মাথা নোয়ানো নয়, মাথা তুলে রুখে দাঁড়াতে জানা, ভয়ের বুকে ত্রাস এঁকে দিতে জানা ক্যাপ্টেন নেমো। নটিলাসের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে তিনি সদর্পে বলেন,I am the law, I am the justice! I am the oppressed, and they are the oppressor! It is because of them that everything I loved, cherished, venerated- country, wife, children, parents- perished as I watched! Everything I hate is there! Keep quiet!”


সবার ভিতরে আসলে বাঁচেন নেমো। কেউ তাঁকে খুঁজে পান। কেউ সন্ধান পান তাঁর সেই নটিলাসের। অনায়াসে তখন তিনি ভেসে পড়েন অতল যাত্রায়। প্রফেসর আরোনাক্সের মতন সহ অভিযাত্রী খোঁজেন নেমো। নইলে তাঁর এই অভিযাত্রার সাক্ষী রইবে কে?

মন তো মহাসাগর। চেতন তো কেবল তার ঢেউ এর ফেনা। অবচেতন আর অচেতনে যে কত জনমের মণি মুক্তোর ডুবো দ্বীপ তার খবর নেয়ার সময় আজ আর আমাদের কোথায়? কত স্মৃতি, কত ছবি সেখানে গাছ হয়ে ফুলে ফলে সেজে রয়েছে- সে দেখার অবকাশ কই? যে স্মৃতিরা একটু খানি হাত বুলোনো আদরের অপেক্ষায় বসে আছে অভিমানে তাকে আদর করবার অবসর কই? দৌড়ের ব্যামো কলোনি বানিয়ে বানিয়ে ক্রমশঃ ছেয়ে ফেলছে চেতন অবচেতনের বিভেদ তল।

তবু এরই মাঝে কেউ কেউ আলাদা হয়ে ঘুরে আসেন মাঝে মাঝে সেই আবছায়া দ্বীপপুঞ্জে। মন অধ্যাপক আরোনাক্স হয়ে উঠলে হাত বাড়িয়ে নটিলাসে তুলে নেন ক্যাপ্টেন নেমো। সেই গহিনযাত্রার অভিজ্ঞতাটুকু কেউ কে কলমে খাতায় লিখেও ফেলেন।  জন্ম নেয় অন্তর্জগত আর বহির্বিশ্বের সমন্বয়ী অক্ষর মালা। উদাহরণঃ কিশোর ঘোষের কাব্যগ্রন্থ- সাবমেরিন।

                                    জলের উপরে শুধু জলের তলার কানাকড়ি
                                    সিবিচ জেনেছে যারা, বোঝেনি ছড়ানো বালিঘড়ি

ঠিক যেন সমুদ্রের অতলে বালিয়াড়িতে হাঁটবার সময় প্রফেসর আরোনাক্সের অভিব্যক্তি। চারপাশে বিস্তৃত সি উইড, কোথাও সি আনিমোনের কুঞ্জ থেকে বেরিয়ে পড়ছে খেলামগ্ন ক্লাউন ফিশের ঝুন্ড আবার কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে অক্টোপাশের শুঁড়, হাঙরের ধারালো দাঁত!

সাবমেরিন অতলযাত্রার বাহন। নিজের জানালায়, ভিতরের মনিটরে সে নিত্যি ফুটিয়ে তোলে সেই সময় দিনের অনায়াস ছবি। সবাই কখনও সওয়ারি হন নিজের নিজের সাবমেরিনেঃ
                                    সবাই কম-বেশি...সাবমেরিন অনুভব করে
                                                                                    পবিত্র আত্মার লিঙ্গে

কিশোর ঘোষ সেই সাবমেরিনের যাত্রী হয়েছেন। অনন্ত সাগরে যে মুহূর্তে ভেসে উঠেছে তার সাবমেরিন সাগরের জলে ডেকে শুয়ে পাকা নাবিকের মতন চেয়ে রয়েছেন তিন আকাশের দিকে। একই ভাবে আকাশও চেয়ে রয়েছে তারই দিকে। আকাশে অসংখ্য স্বপ্রভ ফু্ল। নিজেদের মত ঝুলে আছে অনন্ত শূন্যে। এ দেখা তো সহজ দেখা নয়।
                                   উপরে তেরোশো সত্তর কোটি তারার ক্যামেরা
                                    সাবমেরিনে সমুদ্র ভ্রমণ
                                                 লাইভ সৌরজগৎ- আকাশ-টিভি দেখাচ্ছে

সেই মন সমুদ্রের তলায় যেতে যেতে ্ক্যাপটেন নেমোর মতনই কিশোরও দেখছেন সমাজের শোষক-শোষিতের অনিবার্য চিত্র। শিয়ালদা স্টেশান অথবা ফুটপাথের ঘুম, ঘাম, রক্ত দেখছেন কিশোর। ভ্রান্তির বিষ ছড়িয়ে মাস হিস্টিরিয়ায় আচ্ছন্ন সমাজের অসভ্য প্রতিক্রিয়া দেখছেন কিশোর, দেখছেন সেই মূর্খ প্রতিক্রিয়া শেষে ঘুম ধোঁয়া ছড়ানোর চালাক রাজা মন্ত্রীদের উন্মত্ত উল্লাস, রোস্টেড মাংস আর স্বাস্থ্য পানের আধুনিক মেনুতে হিংস্র শ্বদাঁতের ঝিলিক। এত কিছু ঘটে চলেছে তবু শহরের ঘুম ভাঙে না! অদ্ভুত অন্ধকারে নিজেকে আচ্ছন্ন করে উটপাখি হয়ে বেঁচে থাকছে নয়, কেবল শ্বাস নিচ্ছে মানুষ। পাশের শহরে যখন  শিশুরা মারা যাচ্ছে অনাহারে অথবা সিসার আঘাতে, তখন গলফ কোর্সে শাদা বল ঝলকে উঠছে সোনালি সকালে! কেউ দেখছে না, কেউ ভাবছে না, ভাবলেও বলছে না কিচ্ছু! ঠিক সেইই ইটের পাঁজায় বসা রাজার মতন ‘ঠোঙা ভরা বাদামভাজা, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’।

                                    গ্যারেজে কাজ করে দিন।
                                    বিনিময়ে ময়লা মাইনে পায় খিদে
                                    বুঝে নাও, এই সেই রাতের আকাশ
                                    শিশুশ্রমিকের হাতের তালুর মতো
                                                                        অসহায় কালো-

এই সাবমেরিন কিশোরের অন্তর্যাত্রা। সাধন যাত্রাও যদি বলি, খুব ভুল হয়তো হবে না। মনসমুদ্রের ঢেউ হলো চিন্তা আর বাতাস সেই ঢেউ ফোটায়। যদি সেই বাতাস বন্ধ করে প্রবেশ করা যায় অন্তর্সমুদ্রে ঢেউ ক্রমশঃ কমে কমে আসে। এক সময় থেমে যায়। নিস্তরঙ্গ সেই চিদাকাশে ভাসতে ভাসতে কেবল দেখে মন, কোনো বিকার হয় না তার। এ কথা বলছি, কারণ কিশোর লিখেছেনঃ

                                    দু’জন ঈশ্বরকণার থাকা ও না থাকা এক,
                                                                        সূর্যের ঘড়িতে তখন শূন্যটা বাজে

অথবা লিখেছেন,             সাবমেরিন তুমি যে ছিলে তাই
                                    প্রগলভ
                                    গভীরে দিল ডুব
                                    ডুবুরি ঠিক খুঁজেও পেল ভুল-

                                    মৃত্যু তার
                                    জন্ম চিনে নিল

এই খানে পৌঁছতে পৌঁছতে যে সব চিত্রকল্প পেরিয়ে এসেছেন কিশোর, সে সবই হয়তো তার কোনো না কোনো বয়সের, বলা ভালো কোনো না কোনো জনমের খন্ড চিত্র। সেখানে অনিবার্যভাবে প্রেম দাঁড়িয়ে, বিরহ দাঁড়িয়ে, চাওয়া, না পাওয়া, ক্ষোভ, বিষাদ, শ্রদ্ধা, প্রণাম সব কিছুর বিচ্ছিনন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ আছে। সেই সব বিচ্ছিন্ন দ্বীপের ভ্রমণ করাচ্ছে সাবমেরিন। সেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মিলিয়েই যে মালা তাঁর নাম জীবন। জীবনের নাম এখানে অনশ্বর। আর অনশ্বরের ভ্রমণ সঙ্গী সেই সাবমেরিনের বিদগ্ধ যাত্রীর নাম এখানে কিশোর ঘোষ। পড়ে দেখুন অনুভবী পাঠক। ভালো লাগবেই।

Comments

Popular posts from this blog

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যাচ্ছেন কি? যাচ্ছেন কোথায়? লাখ টাকার প্রশ্ন! বিজ্ঞানের এক উত্তর, শিশু ভোলানাথের এক উত্তর, গোঁয়ার গোবিন্দর এক উত্তর, বোদ্ধার এক উত্তর! ঘন রহস্য! অথবা কোনোই রহস্য নেই। কৃষ্ণ কেমন, না যার মন যেমন। জলে হাওয়ায় গেলাস ভরা ভাবলে ভরা, আধখানা খালি ভাবলে খালি। আসল কথাটা হলো আজ বছরের শেষ সন্ধ্যে। আজ হেব্বি সেলিব্রেশন! কোথাও জামাল কুদু, কোথাও লুটপুট গয়া তো   কোথাও দিন হ্যায় সানি সানি সানি-   চারপাশ থেকে নানা রকমের গান ভেসে আসছে। একের সুরে আরেক চেপে বসায় কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না মনে। এমনটাও ভালো। এতেও এক ধরণের নির্লিপ্তি আসে। নির্লিপ্তিই তো মুখ্য, নির্লিপ্তিই মোক্ষ। আজ ভর দুপুরে ছাদে গিয়ে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছপালাগুলোর একটু পরিচর্যা করলাম। খালি দুটো টবে দুটো বীজ পুঁতলাম। একটা উচ্ছের  আর একটা ঢেঁড়সের । এই দুটোই আসলে আজকের বর্ষ শেষের আমি। কাজের দুনিয়ায় যেমন তেঁতো, ঘরের দুনিয়ায় তেমনি ঢেঁড়স। তো দুই আমিকে বছর শেষে দিলাম পুঁতে। নতুন ভোরে খোলস ছেড়ে বেরি

অসুস্থ সমাজ, অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং নিছক সাধারণী আবেদন

  ডাক্তারদের অনশন আজ ১০ দিনে পড়ল । পাঁচই অক্টোবর থেকে আমরণ অনশনে বসেছেন। প্রথমে ছ'জন পরে আরো একজন , উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে আরও দু'জন জুনিয়র ডাক্তার আমরণ অনশনে বসেছেন। বলছি বটে জুনিয়র, কিন্তু যে পর্যায়ের পরিণত মনোভাব এঁরা দেখিয়েছেন এবং দেখাচ্ছেন চিকিৎসা পরিভাষায় যাই হোক, মানবতার পরিভাষায় এরা সিনিয়রস্য সিনিয়র।  অনশন। কেবল জল। আর কিছু নয় । বলাই সহজ, কাজে মোটেই সহজ নয়। একবার রাগ করে না খেয়ে একবেলা ছিলাম। আর মনে পড়ে আর একবার মায়ের সাথে উপোস করেছিলাম কোজাগরি পূর্ণিমায়। দুবারই সন্ধ্যে হতে না হতেই হাটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগেছিল। আর টানা 10 দিন অভুক্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা! এখনো চলছে তাঁদের অনশন ব্রত।  শারীরিক সমস্যা জয় করতে হচ্ছে। জনমানসের আশা প্রত্যাশার পাহাড় জয় করতে হচ্ছে। মানসিক চাপ জয় করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের চাপ। সহজ কথা তো নয়। তাও জয় করতে হচ্ছে। অকথা কুকথাকে খড়কুটোর মত ছুঁড়ে ফেলে পাখির চোখে চোখ রাখতে হচ্ছে। কেন করছেন তারা অনশন? রাজ্যে গত নয়-ই অগস্ট নারকীয় ঘটনা ঘটে গেছে আর জি কর মেডিকেল কলেজে। তাদেরই সহকর্মী দিদি অথবা বোনের নৃশংস পরিণতি তাঁদের মুঠো শক্ত করেছে। চ

এসো মা, এসো মা উমা

 শাশ্বত কর সুপ্তপর্ব “যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে! গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!” ঠাকুর দালানে ধুনুচি সাজানো হচ্ছে। এও এক শিল্প! নারকেলের ছোবড়া উল্টো করে এমন করে সাজা হবে যে ধুনুচি নিম্নমুখী হলেও সহজে পড়বে না! নইলে আরতি জমবে কেমন করে!  ছোবড়া চুঁইয়ে ধোঁয়া মিশছে বাতাসে। বাতাসে ধুনোর গন্ধ! বাতাসে কর্পুরের গন্ধ! বাতাসে শিউলি, ছাতিম, বাতাবি ফুলের গন্ধ! বাতাসে ঠান্ডা আদর! আদর আমার গালে। মায়া আদর, আচ্ছন্ন আদর। যে সুগন্ধী বাতাস নাকি গোলাপের মৃদু পাঁপড়ি এই আদর এঁকে গেল, এই তো খানিক আগে যখন তেতলার চক বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচে ঠাকুরদালানের পাশে রাঙাপিসিমাদের আড্ডা দেখছিলাম, তার নাম এখানে লেখার কীই বা দরকার? গতকাল সকালে পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা সেই আমায় দিয়েছে, ভিড়ের অছিলায় আঙুল ছুঁয়ে গেছে। কাছে আসলেই মায়ের পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা আমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক পুব বাগানের বাঁধানো বেদির পাশে রাত আলো করে থাকা নিশিপদ্মের মতো! এ গন্ধের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা! এখন যেমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি চক বারান্দায়। হাতে শ্রীশঙ্খ! ঠাকুর তোরঙ্গ থেকে বড় শাঁখখানা আনতে পাঠিয়েছিলেন র