Skip to main content

নতজানু হয়ে শিখে চলি

 


“এত বিদ্রোহ কখনও দেখেনি কেউ

দিকে দিকে ওঠে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ”

ঢেউই বটে। স্বতঃস্ফূর্ত যে ঢেউ আছড়ে পড়ছে ক্রমাগত- কার সাধ্য তার পথ আটকায়! ঘৃণ্য, মনুষ্যেতর ঘটনা ঘটেছে এই শহর কলকাতার বুকে- ঐতিহ্যশালী সরকারি হাসপাতাল আর.জি.করে-এ। এক টানা ছত্রিশ ঘন্টা সেবা প্রদানের পর কর্মক্ষেত্রেই ধর্ষিতা হয়ে খুন হতে হয়েছে চিকিৎসক তিলোত্তমাকে। এই জোরালো আঘাত নাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের মন। দীর্ঘদিন এই মন আবদ্ধ ছিল। আবদ্ধ ছিল নানান বাঁধনে। হতে পারে তা আপাত কর্মব্যস্ততা, হতে পারে বিভ্রান্তি, হতে পারে জীবিকা অর্জন, হতে পারে ভীতি, হতে পারে লোভ, হতে পারে উদাসীনতা, হতে পারে পলায়নপ্রিয়তা, হতে পারে আরও অনেক কিছু। মোদ্দা কথা, সমাজের মন বদ্ধ ছিল। এই ভয়ানক ঘটনা সেই বাঁধন খুলে দিল।

কোনো মেয়ে সুরক্ষিত নয়। কেউ সুরক্ষিত নন। আইন, নিয়ম সব আছে। কিন্তু নীতিহীনতা, মনুষ্যত্বহীনতা, ক্ষমতার দাপট সেই সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। অস্তিত্বের টান বড় টান। মরমে আঘাত বড় আঘাত। সেই আঘাত নেমে আসল তিলোত্তমা হয়ে পশ্চিমবাংলার সমস্ত মানুষের মনে, প্রধানত নারী মানসে। বহুদিন পর স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দেখল সমাজ। স্বীকার করতেই হবে- নারী পরিচালিত আন্দোলন দেখল সমাজ। স্বাধীনতার আগের রাতে ‘মেয়েরা রাত দখল করো’। অচেনা এক বোনের ডাক ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ল সমাজের অলিন্দে অলিন্দে। ‘রাত’ কেবল দিনের শেষে ঘনিয়ে আসা অন্ধকার নয়- মেয়েদের প্রতি সংঘটিত যুগ যুগান্তের দমন পীড়ন, অপমান, অসম্মান, স্বাধীনতা হরণের অন্ধকার। সভ্যতার অন্ধকার। সেই অন্ধকার রাতের দখল নিলেন মেয়েরা। মশাল জ্বলল। মোমবাতি জ্বলল। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলল। সমবেত আওয়াজ উঠল বাংলার শহরে, গ্রামে, প্রত্যন্ত স্থানেও- বিচার চাই- ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।

সেই শুরু। বিপুল তরঙ্গ রে! ক্রমশঃ ঘন হল তরঙ্গ। গোটা পশ্চিমবঙ্গে। সমস্ত মেডিকেল কলেজগুলোতে চিকিৎসকরা আন্দোলন গড়ে তুললেন। রাজপথে নেমে আসলেন সাধারণ মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের গন্ডী পেরিয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ল আন্দোলনের ঢেউ। দেশ ছাড়িয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ছাড়িয়ে লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, গ্রিস- সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল আন্দোলনের ঢেউ। উই ওয়ন্ট জাস্টিস। উই ডিমান্ড জাস্টিস। জাস্টিস ফর আর.জি.কর! আমি- উত্তম পুরুষ ছেড়ে আমরা- প্রথম পুরুষের এমন সাধনা শেষ কবে এই বঙ্গ সমাজ দেখেছে?

ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া। বিরুদ্ধ অভিঘাত ঘটানোর অপচেষ্টা। তাও চলতে থাকে সংগঠিত ভাবেই। আর.জি.কর. হাসপাতালে রেনোভেশনের নামে পরিকল্পিত ভাঙন চলে! মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচীর রাতেই ভেকধারী গুন্ডাদের তান্ডব চলে। ভাবনা চিন্তা গুলিয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিত ভাবে অজস্র ফেক অডিও, ফেক ছবি ভাইরাল হয়। অদ্ভুত লাগে, এই আজকের দিনেও এই সব বালখিল্যপনা ধরার মতো যথেষ্ট মেকানিজম কি নেই? থাকেই যদি, সেই সব ফেক অডিও কারা বানাল, কারা ছড়াল- সে নিয়ে কংক্রিট কোনো খবর আজ অবধি পাওয়া গেল না! কেবল তম্বিতম্বা আর আস্ফালন। কেবল দোষারোপ করতে শোনা গেল এই সব ফেক অডিও নিয়ে। সন্দেহটা সে জন্যই ঘনিয়ে ওঠে! এ ছাড়া অপ্রশাসনিক মঞ্চাসীনদের ধমকি- হুমকি, প্রশাসনিক বাধা, নিয়ম কানুনের গেরো, আমি তোমাদেরই লোক হইয়ে সব কিছু ঘেঁটে দেওয়া- ইত্যাদি ইত্যাদি সম্ভাব্য, ছকবাঁধা বাধা চেষ্টা সবকিছুই হল এই ঢেউ সামলানোর জন্যে। কিন্তু এই সমস্ত বাধা যত মাথা তুলল, মানব সমুদ্রে খড় কুটোর মতো যে ভেসে গেল তা কেবল নয়, উলটে শক্ত করল আন্দোলনকারীদের প্রত্যয়।

একটা কথা ভাবতেই হবে, বুঝতেই হবে। এই আন্দোলনটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া না। কোনো ক্ষমতা দখলের লড়াই আন্দোলন না। সমস্ত সাধারণ মানুষের সাধারণ চাহিদা- সুরক্ষার চাহিদার লড়াই। কেউ শিখিয়ে দেয়নি। কেউ জোর করেনি, কেউ ভয় দেখায়নি- আন্দোলনে যেতে কেউ কাউকে বাধ্য করেনি। কোনো একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির আন্দোলন কিন্তু এটি না। দুর্নীতির অজস্র উদাহরণ এ পর্যন্ত মাথা তুলেছে এই পশ্চিমবঙ্গে। আলাদা আলাদা করে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন মানুষ। কিন্তু এই যে নিরাপত্তাহীনতা- এ তো সর্বজনীন। মানুষের যখনই মনে হয়েছে এমন পাশবিক ঘটনাও নির্লজ্জভাবে আড়ালের চেষ্টা চলেছে- মানুষ আরও নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেছেন। কেউ নিরাপদ নন। ঘৃণ্য অপরাধী যদি বেমালুম ছাড়া পেয়ে যায়, ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারীর যদি শাস্তি না হয়, তাহলে তো এর পর অনেকের মনের লুকিয়ে থাকা প্রচ্ছন্ন পাশবিক সত্তা একেবারে দাঁত নখ বের করে ফেলবে!

পোশাক ঠিক ছিল না, রাতে বেরোয় কেন, এত জনের সাথে মেলামেশা করে কেন- এই সব অন্যায় অজুহাতে আড়াল করতে চাইবে অপরাধকে, পিছিয়ে দিতে চাইবে সভ্যতাকে। নির্লজ্জভাবে। ছোট ঘটনা, সারা পৃথিবীতেই হয়ে থাকে- আমাদের বাংলা তবু অনেক নিরাপদ- এই সব বিশেষণ অপরাধী মনকে আশ্বস্ত করবে। ক্ষমতার অলিন্দে টিকে থাকার লোভ তার চারপাশে ঘুরঘুর করা নীতিহীনতাকে আড়াল করবে। এই তো ঘটে। এই তো ঘটেছে। মূল সমস্যা তো বিকৃতমনস্ক অপরাধীর মনে- সমস্যা তো সেই অজুহাত প্রদানকারী বিকৃত পুরুষ অথবা নারীর মনে। এই সব আড়াল পরোক্ষে প্রশ্রয় দিয়েছে অপরাধকারী বিকৃত মানুষের মনে লুকিয়ে থাকা পাশবিক আদিম অভ্যাসকে। সভ্যতা কী দাবী করে? সাদা কালোর সঠিক অভিব্যক্তি, নিরপেক্ষ প্রশাসন- এগুলোও তো অন্যতম দাবি সভ্যতার। কিন্তু তা কি হয়?

অজস্র মনের গভিরে প্রচ্ছন্ন থাকা বিকৃত সেই পশুটিকে তো ভয় পাওয়াতে হবে। কে ভয় দেখাবে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বদলে আইনের ফাঁক ফোঁকড় খুঁজে, অপরাধ মূলক ষড়যন্ত্র করে আড়াল করা হলে তো উল্টে সে প্রশ্রয় পাবে! দিনে রাতে সবাই সমান ভাবে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবেন, পথে বেরোতে পারবেন- সেই অধিকারটুকু, সেই নিরাপত্তাটুকু তো সুনিশ্চিত করতে হবে। কে করবেন? কেউ তো করছেন না। উলটে রাতে কাজ কমিয়ে আনার নিদান দিয়ে প্রকারান্তরে বিপরীত পথে হাঁটছেন। যখন কেউ কথা শুনছেন না, কৌশলে অথবা আক্ষরিক অর্থে পাত্তা না দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন- তখন নিজেদের মুঠো শক্ত করা ছাড়া আর উপায় কী?

এই লড়াই এর আবেগে তিলোত্তমা আজ সব ঘরের মেয়ে। আক্ষরিক অর্থে বাংলার নিজের মেয়ে। এই আন্দোলন ঘরের মেয়ের উপর পাশবিক অত্যাচারের সুবিচার আদায় করে নেওয়ার আন্দোলন। কেউ যখন প্রাপ্য অধিকার দেয়না, যখন প্রাপ্য বিচারের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার জন্য সমষ্টিগত ভাবে ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়, যখন সমকালীন অজস্র ঘটনাক্রম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- সুবিচার পাওয়ার আশা কতটা ক্ষীণ, আইনের ফাঁক গলে অপরাধীদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ কতটা বেশি, আদৌ সব অপরাধীদের চিহ্নিত করা হবে কি না সে নিয়ে যখন তীব্র সংশয় তৈরি হয়- তখন অহিংস আন্দোলন ছাড়া আর পথ কোথায় সাধারণ মানুষের?

সাধারণ মানুষ। আদতে কতটা যে অসাধারণ – তা তাদের নিত্যদিনের বেঁচে থাকার লড়াই সংগ্রামে মালুম হয়। সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে যে অসাধারণত্ব- সেটুকু অর্জন করতে পারেন বলেই তারা সাধারণ। চাওয়া না চাওয়ার , পাওয়া না পাওয়ার ওঠা নামাকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকতে পারেন সাধারণ মানুষ। দিনের পর দিন ঠকেও ফের সেই প্রবঞ্চককুলকেই বিশ্বাস করতে জানেন সাধারণ মানুষ। স্বপ্ন দেখতে জানেন সাধারণ মানুষ। এই কঠিন সময়েও সততার পথে, শিক্ষার পথে, মনুষ্যত্বের পথে হাঁটতে জানেন সাধারণ মানুষ। সহজে ভুলে যেতে পারেন সাধারণ মানুষ। মান, অপমান- বেমালুম ভুলে যেতে পারেন। ভোটের আগে দেওয়া ভোটভিক্ষুকদের লাখো লাখো প্রতিশ্রুতি ভুলে যেতে পারেন। গোল গোল কথার ধার ধারেন না সাধারণ মানুষ। সহজে বশ হন সাধারণ মানুষ। সহজে অনুগামী হন সাধারণ মানুষ। জাহাজের খবর চান না সাধারণ মানুষ। পরিবার নিয়ে যেন তেন প্রকারেণ দোর আটকে সাধারণত শান্তিতে থাকতে চান সাধারণ মানুষ।

সেই সাধারণ মানুষের যদি ঘুম ভেঙে যায়, তা হলে তাদের উপর ভর করে বেঁচে থাকা অসাধারণ চতুরকুলের কী হবে? সাধারণের ভ্রান্তির উপরেই তো তাদের বোলবোলা! তারা তো সন্ত্রস্ত হবেনই। তারা তো চাইবেনই সব কিছু ঘেঁটে দিতে। আসলে তারা তো সাধারণ মানুষের কোনো বিষয়ে লেগে থাকার ক্ষমতা, বেঁচে থাকার জন্য দৈনন্দিন লড়াই এর কথা ভালোভাবে জানেন। খুব স্বাভাবিক ভাবে তাই তারা হাতিয়ার করবেন সাধারণ মানুষের ধৈর্যকে। ঢাল করবেন সাধারণ মানুষের বৈষম্য, বিভাজনকে। বিভাজন না থাকলে সুকৌশলে বিভাজন ঘটাতে চাইবেন। মাস্কিং রিঅ্যাকশনের মতো অন্য সব ছেঁদো ঘটনা ঘটিয়ে সেদিকে সাধারণের মন ঘুরিয়ে দিতে চাইবেন। এদের চেনা যাবে না। এরা বন্ধু শত্রু কখন যে কোন বেশে প্রতীয়মান- সে সব বোঝা যাবে না। সাধারণের ভিড়ে দাঁড়িয়ে তারা নষ্ট করতে চাইবেন আন্দোলনকে। এমনটাই তো হয়ে আসে। প্রতিবার।

এখানেই তফাৎ এবারের এই স্বতঃস্ফূর্ত দাবি আদায়ের ঢেউ এর। বৈষম্য, বিভাজন ভুলে এবার একসাথে হাঁটছেন মানুষ। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান এক সাথে চিৎকার করে দাবি জানাচ্ছেন। বিচার চাই, বিচার চাই। মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচীতে সুশৃঙ্খল ভাবে সামিল হচ্ছেন পুরুষ। লিঙ্গ বৈষম্য নয়- নারী পুরুষ তৃতীয় লিঙ্গের সব মানুষ একসাথে, এক যোগে শ্লোগান তুলছেন- বিচার চাই, বিচার চাই। ডাক্তার, শিক্ষক, ছাত্র, কর্মচারী, থিয়েটারকর্মী, টলিপাড়া, বইপাড়া- একসাথে মুঠোবদ্ধ হাত আকাশে তুলছেন- বিচার চাই, বিচার চাই। শৈশব কৈশোর তারুণ্য বার্ধক্য গলা তুলছেন- বিচার চাই, বিচার চাই। দিন আনি দিন খাই মানুষের দল, স্বাক্ষর- নিরক্ষর সব মানুষের দল একসাথে স্বর তুলছেন- বিচার চাই, বিচার চাই।

কোথাও একটা ক্ষোভ ছিল। যে নাগরিক সমাজ তেরো বছর আগে এই বাংলায় পরিবর্তনের কান্ডারী হলো- এই চরম দুর্দিনে, এই সংহত আন্দোলনের দিনে তাঁরা কোথায়? কোথায় সেই বুদ্ধিজীবীরা? চেষ্টা চলছিল সেই বিভাজনটুকুও জাগিয়ে তোলার। কাজ দেয়নি। শিল্পী, গায়ক, অভিনয়কর্মীরা আলাদা আলাদা পরিসরে রাজপথে সাধারণ মানুষের পাশে শ্লোগান তুলেছেন। বুদ্ধিজীবীর মুখ বদল হয়েছে কখনও এ কথা সত্য হলেও নতুন মুখদেরও যে এই আন্দোলনে দেখা গেছে। তাই বা কম কী? তিলোত্তমার জন্য কবিতা লিখেছেন কবিরা, ক্যানভাসে- রাজপথে প্রতিবাদের অক্ষর এঁকেছেন শিল্পীরা। প্রতিবাদের গান গেয়েছেন শিল্পীরা। উই শ্যাল ওভার কামের সাথেই সমবেত কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে অরিজিৎ সিং সদ্য বাঁধা ‘আর কবে’। কতদিন এমন গণসঙ্গীত শোনেনি বাংলার মানুষ। কতদিন একসুরে গায়নি এমন করে! চোদ্দই আগস্টের রাতের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে পয়লা সেপ্টেম্বর। নাগরিক সমাজ নেমে এসেছেন রাজপথে। সেলিব্রিটি থেকে সাধারণ মানুষ- সবাই এক। ‘আমি তিলোত্তমা’। হাজার কন্ঠের তিলোত্তমার সাথে ফের রাতভর শ্লোগানে মুখরিত হয়েছে কলকাতা। চাওয়া একটাই- বিচার, সুবিচার- সব দোষীদের শাস্তি।

আন্দোলনে দুলে ওঠেনি কি ক্ষমতার আসন? টলেছে তো! কেউ কেউ নিরাশা ছড়াচ্ছেন। কিছু হবে না। কিছু হয় না এসব করে। হলো তো! অজস্র তালবাহানার পরে শেষ অবধি গ্রেফতার হয়েছেন তো আর.জি.কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ! সমবেত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছাড়া কি হতো? যে কারণেই গ্রেফতার হোন, সে কারণ তো আগেও ছিল, হয়েছে কি? হয়নি। এখন হলো। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে হল। সুবিচারের দিকে একটা অন্তত ধাপ তো বটেই। সমাজমাধ্যমের কথা ধার করে বলতে ইচ্ছে হয়- একদিনে হবে না, এক দিন হবে। হবেই।

এ সব তো সবার জানা। প্রত্যক্ষ করা। নতুন কথা কী?

নতুন কথা কিছু না বন্ধু। তবে নতুন বিষয় যে না সে কথাই বা বলি কেমন করে? এ ভাবে সমাজকে জেগে উঠতে এখনও পর্যন্ত তো দেখিনি। আলগোছে সমস্ত রকম ক্ষমতার খাপে খোপে বিচরণপ্রিয় শক্তিদের সমবেতভাবে বর্জন করতে তো দেখিনি। এত ফোকাসড থাকতে সাধারণ মানুষকে খুব বেশি তো দেখিনি। হৃদয়ের সাধারণী আবেগের পারা তাই ঊর্ধ্বমুখী। তাই এই ‘দিনপঞ্জিকা লিখে’ যাওয়া!

রোজ শিখছি এই আন্দোলন থেকে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সম্পর্কে জমে থাকা অসম্পূর্ণ ধারণা, ভুল ধারণা নিত্যদিন ভেঙে যাচ্ছে। যত ভাঙছে, তত শিখছি। নতজানু হয়ে শিখছি। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে শিখছি। প্রৌঢ়া মায়ের কথা থেকে শিখছি। চিকিৎসকদের একতা থেকে শিখছি। এমন নিরলস মনুষ্য সমাজের প্রত্যেকের কাছে হাত পেতে শিক্ষা নিচ্ছি। মন পেতে গুছিয়ে রাখছি মনুষ্যত্বের শিক্ষা।

সুদীর্ঘ ঘুম থেকে সমাজ আজ সত্যি সত্যি জেগেছে। মনুষ্যত্বের এই জেগে ওঠাকে যে সযত্নে লালন করতে হবে- সভ্যতার বারান্দা থেকে সভ্যতার অন্দরমহলেও যে এই বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে আমাদের। সভ্যতার উন্মেষে সহিষ্ণু, সমানুভব, বৈষম্যহীন এক সমাজ জেগে উঠবে আমাদের সাধের বাংলায়- সেই আশা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দর্শনে। আরো শেখাও, আরো শেখাও…আরো শিখি হে সমবেত মানব সমাজ। শিক্ষার দিনগুলোকে লিখে রাখি খাতায়! যদি ফের পথ চলতে চলতে পথ ভুলি, যদি ফের ভয়ে গুটিয়ে যাই শামুক জীবন, যদি ফের ভুলে যাই যুথবদ্ধ পদক্ষেপের শক্তি- ফেরত আসতে পড়তে হবে তো, ফের শিখতে হবে তো!

শাশ্বত কর 

শময়িতা অ্যাপার্টমেন্ট 

দোসরা সেপ্টেম্বর ২০২৪

Comments

Popular posts from this blog

বর্ষ শেষ, থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র আর সাধারণ জীবন

  শাশ্বত কর       বর্ষশেষের সূর্য অস্ত যাচ্ছে। শীত তো পড়েছে। লাল সোয়েটার, মোজা, মাঙ্কিক্যাপে জুবুথুবু বৃদ্ধ সূর্য অস্ত যাচ্ছেন। যাচ্ছেন কি? যাচ্ছেন কোথায়? লাখ টাকার প্রশ্ন! বিজ্ঞানের এক উত্তর, শিশু ভোলানাথের এক উত্তর, গোঁয়ার গোবিন্দর এক উত্তর, বোদ্ধার এক উত্তর! ঘন রহস্য! অথবা কোনোই রহস্য নেই। কৃষ্ণ কেমন, না যার মন যেমন। জলে হাওয়ায় গেলাস ভরা ভাবলে ভরা, আধখানা খালি ভাবলে খালি। আসল কথাটা হলো আজ বছরের শেষ সন্ধ্যে। আজ হেব্বি সেলিব্রেশন! কোথাও জামাল কুদু, কোথাও লুটপুট গয়া তো   কোথাও দিন হ্যায় সানি সানি সানি-   চারপাশ থেকে নানা রকমের গান ভেসে আসছে। একের সুরে আরেক চেপে বসায় কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না মনে। এমনটাও ভালো। এতেও এক ধরণের নির্লিপ্তি আসে। নির্লিপ্তিই তো মুখ্য, নির্লিপ্তিই মোক্ষ। আজ ভর দুপুরে ছাদে গিয়ে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছপালাগুলোর একটু পরিচর্যা করলাম। খালি দুটো টবে দুটো বীজ পুঁতলাম। একটা উচ্ছের  আর একটা ঢেঁড়সের । এই দুটোই আসলে আজকের বর্ষ শেষের আমি। কাজের দুনিয়ায় যেমন তেঁতো, ঘরের দুনিয়ায় তেমনি ঢেঁড়স। তো দুই আমিকে বছর শেষে দিলাম পুঁতে। নতুন ভোরে খোলস ছেড়ে বেরি

অসুস্থ সমাজ, অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং নিছক সাধারণী আবেদন

  ডাক্তারদের অনশন আজ ১০ দিনে পড়ল । পাঁচই অক্টোবর থেকে আমরণ অনশনে বসেছেন। প্রথমে ছ'জন পরে আরো একজন , উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে আরও দু'জন জুনিয়র ডাক্তার আমরণ অনশনে বসেছেন। বলছি বটে জুনিয়র, কিন্তু যে পর্যায়ের পরিণত মনোভাব এঁরা দেখিয়েছেন এবং দেখাচ্ছেন চিকিৎসা পরিভাষায় যাই হোক, মানবতার পরিভাষায় এরা সিনিয়রস্য সিনিয়র।  অনশন। কেবল জল। আর কিছু নয় । বলাই সহজ, কাজে মোটেই সহজ নয়। একবার রাগ করে না খেয়ে একবেলা ছিলাম। আর মনে পড়ে আর একবার মায়ের সাথে উপোস করেছিলাম কোজাগরি পূর্ণিমায়। দুবারই সন্ধ্যে হতে না হতেই হাটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগেছিল। আর টানা 10 দিন অভুক্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা! এখনো চলছে তাঁদের অনশন ব্রত।  শারীরিক সমস্যা জয় করতে হচ্ছে। জনমানসের আশা প্রত্যাশার পাহাড় জয় করতে হচ্ছে। মানসিক চাপ জয় করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের চাপ। সহজ কথা তো নয়। তাও জয় করতে হচ্ছে। অকথা কুকথাকে খড়কুটোর মত ছুঁড়ে ফেলে পাখির চোখে চোখ রাখতে হচ্ছে। কেন করছেন তারা অনশন? রাজ্যে গত নয়-ই অগস্ট নারকীয় ঘটনা ঘটে গেছে আর জি কর মেডিকেল কলেজে। তাদেরই সহকর্মী দিদি অথবা বোনের নৃশংস পরিণতি তাঁদের মুঠো শক্ত করেছে। চ

এসো মা, এসো মা উমা

 শাশ্বত কর সুপ্তপর্ব “যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে! গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে!” ঠাকুর দালানে ধুনুচি সাজানো হচ্ছে। এও এক শিল্প! নারকেলের ছোবড়া উল্টো করে এমন করে সাজা হবে যে ধুনুচি নিম্নমুখী হলেও সহজে পড়বে না! নইলে আরতি জমবে কেমন করে!  ছোবড়া চুঁইয়ে ধোঁয়া মিশছে বাতাসে। বাতাসে ধুনোর গন্ধ! বাতাসে কর্পুরের গন্ধ! বাতাসে শিউলি, ছাতিম, বাতাবি ফুলের গন্ধ! বাতাসে ঠান্ডা আদর! আদর আমার গালে। মায়া আদর, আচ্ছন্ন আদর। যে সুগন্ধী বাতাস নাকি গোলাপের মৃদু পাঁপড়ি এই আদর এঁকে গেল, এই তো খানিক আগে যখন তেতলার চক বারান্দা থেকে ঝুঁকে নিচে ঠাকুরদালানের পাশে রাঙাপিসিমাদের আড্ডা দেখছিলাম, তার নাম এখানে লেখার কীই বা দরকার? গতকাল সকালে পুষ্পাঞ্জলির ফুল বেলপাতা সেই আমায় দিয়েছে, ভিড়ের অছিলায় আঙুল ছুঁয়ে গেছে। কাছে আসলেই মায়ের পুজোর গন্ধ ছাপিয়ে যে গন্ধটা আমায় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সেটা ঠিক পুব বাগানের বাঁধানো বেদির পাশে রাত আলো করে থাকা নিশিপদ্মের মতো! এ গন্ধের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা! এখন যেমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছি চক বারান্দায়। হাতে শ্রীশঙ্খ! ঠাকুর তোরঙ্গ থেকে বড় শাঁখখানা আনতে পাঠিয়েছিলেন র